পোশাকশিল্পে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হাতছানি – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in দৈনিক বাংলা on 28 September 2022

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের একটি পরিণত খাত এবং অন্যতম বৈশ্বিক ব্র‌্যান্ড। আর এটা সম্ভব হয়েছে উদ্যোক্তা, শ্রমিক এবং সরকারের সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে। পোশাকশিল্পের এই অভিযাত্রা সরলরৈখিক ছিল না। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ওঠা-নামা এবং টানাপোড়েন ছিল। তবে আমাদের এই খাতের অবস্থান দেখে বলা যায়, এসব ওঠা-নামা আর টানাপোড়েন কাটিয়ে বাংলাদেশ এখন একটা উজ্জ্বল জায়গায় পৌঁছেছে।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। তখন কিন্তু অনুমান করা যায়নি, আজ এখানে তৈরি পোশাকশিল্প এসে দাঁড়াবে। সে সময় উদ্যোক্তারা পরবর্তী অর্ডার বা শিপমেন্ট কী হবে, সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ফলে আগামী ৫০ বছরে এই খাত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, সে বিষয়ে নির্ধারণমূলক বক্তব্য দেওয়া অযৌক্তিক। তবে বিগত ৫০ বছরে পোশাকশিল্পের অর্জনের ভিত্তিমূল পর্যবেক্ষণ করে আগামীর কিছু পথনকশার ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে। তবে তার আগে গত ৫০ বছরে আমাদের এই খাতের সাফল্য আর দুর্বলতাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করার জরুরত রয়েছে।

এই অর্ধশতকে পোশাক খাতে সবচেয়ে বেশি অর্জন হয়েছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি খাতে। শুরুর ‍দিকে যখন এই খাতে আমাদের মাত্র ৩০০/৩৫০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে, সেখানে এখন ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পরিমাণ রপ্তানি হচ্ছে। তবে বহুগুণ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যতটা না হয়েছে পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে, তার চাইতে বেশি হয়েছে পণ্যের রপ্তানি ভলিউমের জন্য এবং কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রপ্তানির জন্য। এই সময়ে দেশে একশ্রেণির উদ্যেক্তা তৈরি হয়েছে, যারা তাদের পরের প্রজন্মের জন্য তৈরি পোশাক খাতকে রেখে যাবে। এই খাতের হাত ধরে টেক্সটাইল, হোম টেক্সটাইল, এক্সসেরিজের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাসট্রিজ তৈরি হয়েছে। এই খাতের হাত ধরে ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স, কনস্ট্রাকশন, ইলেকট্রনিকস অ্যাপলায়েন্স, একাডেমিক এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মতো সংযোগ শিল্প গড়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আগামী এক দশকে আমাদের কয়েকটি বিষয়ে উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। যেমন- শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। পরিবেশবান্ধব কারখানার ক্ষেত্রে আমরা এখনো হাঁটি হাঁটি পায়ের পর্যায়ে আছি। এখানে আমাদের প্রভূত উন্নতি করতে হবে। এখন আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত বিশ্বে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছি, যেটা আগামীতে না পাওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই এই বিষয়ে এখন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।

আগামীতে তৈরি পোশাকশিল্প খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এটাকে পরিবেশবান্ধব, শ্রমবান্ধব করার পাশাপাশি পণ্যের বহুমুখীকরণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা, ভ্যালু চেইন গুড ফ্লোতে শুধু বড় বাজারে সীমাবদ্ধ না থেকে বাজারের বহুমুখীকরণ করা এবং বিনিয়োগকারীদের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমাদের এটা মাথায় রাখা উচিত, ২০২৬ সালে যখন আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব, তখন সুবিধাগুলো সংকুচিত হয়ে পড়বে। সে সময় আমরা যাতে প্রতিযোগী সক্ষম দেশ হিসেবে অবস্থান করতে পারি, সেটা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। আগামীতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী হাইটেক প্রযুক্তিকে এই খাতে প্রয়োগ করতে হবে। এসব আলোকেই আগামীর দশকগুলো সাজানোর প্রয়োজন পড়বে। এখন সর্বাগ্রে ২০২৬ সালে স্বল্পন্নোত দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটটি বিবেচনা করে তৈরি পোশাক খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগগুলো বিবেচনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। ২০৩০ সালের পর আমরা আর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাব না, সেটাকে মাথায় রেখে পণ্যের বৈচিত্র‌্যকরণ এবং বাজারের বৈচিত্র‌্যকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশেরই একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্তকে আমরা পর্যালোচনা করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা ২০১৩ সালের পর থেকেই শূন্য শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আসছি। কিন্তু সেই সময় থেকে আমরা ভালো পরিমাণ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি করছি। ২০২২ সালেও আমরা সেখান থেকে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। আগামীতে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান, চীন এবং কানাডার মতো বাজারে যখন শূন্য শুল্কে রপ্তানি করব বা শুল্ক সুবিধা সংকুচিত হবে, তখন সেখানকার বায়ারদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের আগের মতো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করার যে সক্ষমতা রয়েছে, সেটা বায়ারদের আশ্বস্ত করতে হবে।

এক্ষেত্রে মূল চাবিকাঠি হবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। সেজন্য প্রযুক্তিগত মানোন্নয়ন করা, শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, কারখানার ম্যানেজমেন্ট বা প্রফেশনালসদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, কারখানার টোটাল প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি করা, কারখানা পর্যায়ের অপচয় কমানোর বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য হাইটেক এবং অ্যাডভান্স মেশিনারিজ ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ধরনের বাজারে আমাদের উদ্যোক্তারা স্বল্পমূল্যের পণ্য রপ্তানি করে হয়তো খুব বেশি মার্জিন ধরে রাখতে পারবেন না, তাই তাদের মিডিয়ামেন্ট বা হাই ইন প্রেডাক্ট রপ্তানির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য কারখানার প্রোডাক্ট কম্পোজিশন চেঞ্জ করা, শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করা এবং উচ্চমূল্যের পণ্যের বায়ারদের আকৃষ্ট করার জন্য নেটওয়ার্ক করার মতো কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সরকারের পক্ষে আগামী দিনে চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারতের মতো বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি করার জন্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ চুক্তি করা যায় কি না, সেই প্রচেষ্টা খতিয়ে দেখতে হবে। সেক্ষেত্রে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট বা সেপা এবং বিশেষ বাণিজ্য চুক্তি বা এসটিএ করার প্রয়োজনীয়তা হতে পারে। এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এসটিএ উইংসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং এ সমস্ত বিষয়ের বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে লিয়াজোঁ বা নেটওয়ার্ক করার বন্দোবস্ত করতে হবে। এই সময়কালে এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করার আলোচনা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

তৈরি পোশাক খাতে পূর্ণমাত্রার কমপ্লায়েন্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে গ্রিন ফাক্টরি তৈরি করা হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, গ্রিন ফাক্টরি পূর্ণমাত্রার কমপ্লায়েন্সের একটি অংশমাত্র। সেখানে আমাদের কারখানার বর্জ্য যেন দূষণ না তৈরি করে, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো যেন পুরোমাত্রার কমপ্লায়েন্ট হয়, সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, শ্রমিকদের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে ২০২৬ কিংবা ২০২৯ এরপর শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বা আইএলওর যে ১৫টি মানবাধিকার-সংক্রান্ত কনভেনশন এবং অন্যান্য বিষয়ের ১২টি কনভেনশন রয়েছে, সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা এবং কালেকটিভ বার্গেনিংয়ের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, এখন চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্টের এবং আংশিকভাবে ইউরোপের যে বাণিজ্য দ্বৈরথ চলছে, তার কিছুটা সুবিধা বাংলাদেশ নিতে শুরু করছে। তবে পূর্ণাঙ্গ সুবিধা নিতে হলে পূর্ণমাত্রার কমপ্লায়েন্ট হওয়া, পরিবেশগত মানদণ্ডগুলোতে উত্তীর্ণ হওয়া, শ্রমিকদের মানদণ্ড মেনে চলা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটানো, হাই এবং মিডিয়ামেন্ট পণ্য রপ্তানির সক্ষমতা অর্জনের মতো বিষয়গুলোর প্রয়োজন পড়বে। ইউরোপ কিন্তু আগামীর জন্য ধীরে ধীরে সার্কুলার ইকোনমিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই আমরা কীভাবে সার্কুলার ইকোনমির অংশ হতে পারি, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে।

আমাদের আগামীর একটি বিষয়কে উপলব্ধি করে কর্মপদ্ধতি সাজাতে হবে। সেটা হলো-২০৫০ এর পরে আমরা তৈরি পোশাক খাতে নতুন এক শ্রেণির উদ্যোক্তাদের দেখতে পাব। তারা সবাই হয়তোবা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তা হবেন। তারা কিন্তু আগের প্রজন্মের মতো শ্রমবহুল কর্মপরিবেশে কাজ করতে অভ্যস্ত হবেন না। কিন্তু শ্রমঘন পরিবেশে কাজ করার জন্য প্রচুর সময় দেওয়া, শ্রমিকদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক তৈরি করা, ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে লিয়াজোঁ মেনটেইন করার মতো বিষযগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এখানে এই সম্ভাব্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মকে এ বিষয়গুলোতে প্রস্তুত করার প্রয়োজন পড়বে।

তবে আগামীতে এই দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি প্রযুক্তিগত দক্ষ থাকবেন এবং প্রযুক্তিবান্ধব হবেন। তাদের মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্প আরও সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হবে-সেটাই বড় আশাপ্রদ হবার বিষয় বলে মনে করি।

লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)