প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও বঙ্গবন্ধু – রেহমান সোবহান

Published in বণিকবার্তা on Tuesday 17 March 2020

২৫ বছর ধরে প্রশাসনিক ও একাডেমিক পর্যায়ে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা এবং লেখা হয়েছে। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যাতে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ ন্যস্ত করার উদ্যোগ গৃহীত হয়। এ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর বাধ্যতামূলক গ্রাম-সমবায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যা তার একটি অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ছিল। বিকেন্দ্রীকরণ নীতি কার্যকরী হয়নি, কেননা বাস্তবে এর অনুশীলন কেমন করে সম্ভব, তা জানা ছিল না। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ বিকেন্দ্রীকৃত কর্মসূচির একটি বিশ্লেষণ এবং এটাকে বঙ্গবন্ধুর মৌলিক পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট হিসেবে ধরে নেয়া ঠিক হবে না। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে কিছু প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যের কর্মসূচি তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে বিকেন্দ্রীকরণ নীতির পক্ষে অঙ্গীকারবদ্ধ। সুতরাং এ নিবন্ধকে বিকেন্দ্রীকরণের চরিত্র ও বিজড়িত অবস্থার ভিত্তি ধরে বিতর্ক সূচনা করার জন্য উত্থাপিত হয়েছে, সেজন্য এটাকে একটি পূর্ণ ব্লু-প্রিন্ট হিসেবে মনে করা উচিত হবে না।

বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় বর্তমান জেলাগুলো ভেঙে মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশের সাতটি মহকুমাকে জেলার মর্যাদা দিতে হবে। তিনি জেলা মন্ত্রণা-পরিষদের বৈঠকসমূহে সভাপতিত্ব করবেন। তার অধীন একজন প্রধান সচিব থাকবেন। তার পদের নাম হবে ‘মহাপরিচালক, জেলা উন্নয়ন’। বিভিন্ন বিভাগীয় উন্নয়ন অধিকর্তারা স্বীয় কাজকর্মের জন্য মহাপরিচালকের কাছে এবং তার মাধ্যমে নির্বাচিত জেলা বোর্ডের কাছেও দায়ী থাকবেন। জেলা বোর্ডের নিজস্ব বার্ষিক বাজেট থাকবে। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব তহবিল থেকে একটি অংশ জেলা বোর্ডের বাজেটের জন্য বরাদ্দ হবে। এই নির্দিষ্ট অংশ ছাড়াও অনুন্নত জেলাগুলোর জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দের ব্যবস্থা থাকবে। সব ধরনের উন্নয়ন সংস্থার কাজকর্ম মহাপরিচালক জেলা উন্নয়ন কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। মহাপরিচালক জেলা উন্নয়ন মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত কর্মসূচি এবং জেলা বাজেটের গৃহীত কর্মসূচি কার্যকরী করার জন্য দায়িত্ব নেবেন এবং দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেই দায়ী থাকবেন। জেলার সব অফিসার জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার অধীনে থাকবেন। তাদের শৃঙ্খলা ও পদোন্নতির ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার হাতেই সর্বময় ক্ষমতা থাকবে। মহাপরিচালক জেলা উন্নয়নের অফিসে বার্ষিক জেলা উন্নয়ন পরিকল্পনার তথ্য সংগ্রহ পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হবে। তারাই আবার এ পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবেন। এসব অফিসে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলীর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকবে। এসব দক্ষ লোককে পূর্ববর্ণিত নীতি অনুযায়ী ঢাকা থেকে জেলায় স্থানান্তর করা হবে।

থানা আইআরডিপি:

পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাজেট প্রস্তুত এবং জেলা পর্যায়ে প্রণীত উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান জেলার মূলকেন্দ্রের অধীনস্থ হওয়াই স্বাভাবিক। তবুও এসব কর্মসূচি কার্যকরী করার জন্য বাস্তবে প্রায়ই জেলা প্রশাসনকে থানা পর্যন্ত নেমে আসতে হবে। প্রতি থানার নিজস্ব থানা পর্যায়ে সংহত থানা উন্নয়ন কর্মসূচি থাকা উচিত। থানার এ ধরনের প্রতিটি কর্মসূচির একজন মহাপরিচালক থাকবেন। তার দায়িত্ব হবে থানা পর্যায়ে উফশী চাষপ্রথা বিস্তৃত করার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন, পরিপূরক উপকরণী সরবরাহ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার, শিক্ষার প্রসার এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির বিস্তৃতি। গ্রামীণ শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকেও তিনি নজর দেবেন। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে কৃষিজাত দ্রব্য প্রস্তুত করা হবে এবং কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার-উপযোগী উপকরণাদি প্রস্তুত ও সরবরাহ করা হবে। এ সবকিছুর পরিকল্পনা এমনভাবে করা উচিত, যাতে পরিকল্পনার অন্তর্নিহিত ব্যবস্থার কারণেই এসব ক্ষেত্রে নিয়োজিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার সুনিশ্চিত হয়। তদুপরি জেলায় অবস্থিত সব ধরনের জনশক্তির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। থানার সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির আরেকটি দায়িত্ব হবে কৃষি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং তা কার্যকরী করা। সুতরাং এইভাবে থানা আইআরডিপি প্রতি বছর থানায় যে জনশক্তি রয়েছে, তার একই হিসাব প্রস্তুত করবে এবং সেই জনশক্তির ব্যাপক ব্যবহারের জন্য একটি বার্ষিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। তারা ব্যক্তিমালিকানাধীন সব জমির হিসাব গ্রহণ করবে। গৃহীত কৃষি সংস্কারের কর্মসূচির আলোকেই তা করা হবে। এভাবে প্রতিটি থানায় ভূমি সংস্কারের বিস্তৃত কর্মসূচি প্রণয়ন ও কার্যকরী করা সম্ভব হবে। থানায় অবস্থিত উন্নয়নকর্মে জড়িত সব সরকারি সংস্থার ওপর সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়বেন থানা কৃষি অফিসার, স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা অফিসার, পশু চিকিত্সক এবং গ্রামীণ শিল্প-বিশেষজ্ঞ। থানা পর্যায়ে এসব বিভিন্ন কর্মসূচির বিস্তৃত পরিকল্পনা প্রণয়ন, পরিকল্পনাগুলোর সমন্বয় সাধন এবং এগুলো প্রত্যক্ষভাবে পরিকল্পনার দায়িত্ব থানা আইআরডিপির মহাপরিচালকের স্কন্ধে বর্তাবে। তিনিও একইভাবে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন শাখার কর্মচারীদের ব্যর্থতা বা সাফল্যের জন্য সরকারের কাছে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকবেন। যেহেতু থানা পর্যায়ে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম, সেহেতু এর মহাপরিচালক অবশ্যই উদ্যোগী, নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। তাই পূর্ববর্ণিত নীতি অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলোয়, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায়, ব্যক্তিগত খাতে এবং স্বেচ্ছাসেবক সংস্থায় কর্মরত অপেক্ষাকৃত গতিশীল ও উদ্যোগী যেসব ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, তাদেরকে থানা সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির দায়িত্ব দিতে হবে। এভাবে থানা সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিটি সামাজিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। গ্রামীণ ‘এলিটচক্রের’ সেবা বা খাতির করার অতীত ভূমিকার অবসান হবে। এসব পদ সরকারের শ্রেষ্ঠ উপাদান দ্বারা পূরণ করতে হবে। কম বেতন দিয়ে অবহেলিত এবং হতাশ লোকজনকে এসব পদে আসীন করার অর্থ হচ্ছে অনিবার্যভাবে দুর্নীতির দিকে এদেরকে ঠেলে দেয়া। সুতরাং এ কথা স্বীকার করা উচিত সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির মহাপরিচালকের পদটি যথেষ্ট কর্তৃত্ব ও সম্মানসম্পন্ন পদ। এমনকি অভিজ্ঞ কম পর্যায়ের অফিসাররাও একে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। এভাবে থানা পর্যায়ে যত বেশি দায়িত্বশীল ও নিবেদিতপ্রাণ লোক নিয়োগ করা যাবে, ততই থানা এলাকায় বাস্তব জীবনধারার ওপর পরিবর্তনের একটি বিরাট অভিযানের সূচনা হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, থানার মতো একটি ক্ষুদ্র এলাকায় যদি প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও সম্পদের বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে অনেক বেশি উচ্চহারে ফল লাভ করা সম্ভব হয়। পক্ষান্তরে কর্তৃত্বের পরিধি যতই বিস্তৃত হতে থাকে এবং জনগণও প্রত্যক্ষ উত্পাদন থেকে যতই বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী হয়ে যেতে থাকে, ততই তার বাস্তব নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ও কার্যকরী দক্ষতা হ্রাস পেতে থাকে। থানা আইআরডিপির জন্য একটি পরামর্শদাতা কমিটি নির্বাচন করতে হবে। এ কমিটিতে গ্রাম-সরকারগুলোর চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হবেন। প্রত্যেক চেয়ারম্যানের কার্যকলাপ হবে মাত্র এক বছর। এইভাবে থানার অধীনস্থ সব গ্রাম-সরকারপ্রধানই পালাক্রমে পরামর্শদাতা কমিটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। থানা সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা বোর্ডের প্রধান হলেন স্থানীয় এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। চেষ্টা করতে হবে যাতে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকা একটি থানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অবশ্য কোথাও কোথাও নির্বাচনী এলাকা একাধিক থানা নিয়েও গঠিত হতে পারে। সংসদ সদস্যদের উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার তাত্পর্য হচ্ছে, এতে তারা নিজ নিজ এলাকার জনগণের মতামত উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রতিফলিত করতে পারবেন। ফলে আইআরডিপির মহাপরিচালকের কাজকর্মের সুবিধা হবে। কারণ তিনিই প্রশাসন, জনগণ এবং সংসদের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে ভূমিকা পালন করলেন। যেসব পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করার প্রয়োজন হয়, সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের সেতুর মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন অনিবার্য। এভাবেই সম্ভব হবে গ্রামীণ জীবনের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন।

গ্রাম সরকারের ভূমিকা:

চূড়ান্ত গ্রাম সরকারের ভূমিকা বিশ্লেষণে উন্নয়নের মূল একক হচ্ছে গ্রাম। তাই ইউনিয়ন পরিষদ একটি বাহুল্য বিধায় তাকে পুরোপুরি বাতিল করা যেতে পারে। গ্রাম সরকারগুলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে এবং গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার উপায় প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদের নিজস্ব আয়ের উত্স হবে স্থানীয় কর আদায় এবং জেলা বাজেটের বরাদ্দ। জনশক্তির ব্যবহার এবং ভূমিসংস্কারের প্রাথমিক কর্মসূচি গ্রামপর্যায়ে প্রণীত হবে। এসব গ্রাম পরিকল্পনার ভিত্তিতেই থানা পরিকল্পনা প্রণীত হবে। অবশ্য যতদিন পর্যন্ত গ্রামে এসব কাজ করার জন্য যথেষ্টসংখ্যক দক্ষ লোক পাওয়া যাবে না, ততদিন থানা থেকে কিছু কিছু দক্ষ লোককে এ কাজের জন্য ধার দেয়া যেতে পারে। এভাবে গ্রামে গ্রামে জমি ও শ্রমের পূর্ণ ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। উফশী চাষ পদ্ধতি এবং জলসেচের প্রসারের ভিত্তিতে একটি ব্যাপক উত্পাদন পরিকল্পনা প্রণীত হবে। স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহ করে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনাও নিতে হবে। গ্রামীণ শিল্পগুলোর উদ্বৃত ক্ষমতা সদ্ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রণীত হবে। এসব পরিকল্পনাই একত্রে জমি ও জনশক্তির পূর্ণব্যবহার নিশ্চিত করবে। এ পরিকল্পনাগুলোর প্রতিটিতে যেসব স্থানীয় উপকরণ ব্যবহূত হবে, তার বিস্তৃত বর্ণনা থাকা চাই। যেমন এগুলো কতটুকু স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে, কতটুকু করার্জিত মুদ্রার মাধ্যমে এবং কতটুকু শ্রম খাজনার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে, তার উল্লেখ থাকা চাই। প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতি বছর ১০ দিন বিনা বেতনে সমাজের জন্য শ্রম দিতে হবে। এভাবে আহরিত স্থানীয় সম্পদের সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে থানা আইআরডিপির বরাদ্দ সম্পদ যুক্ত হবে।

ক্ষমতা এবং সম্পদের হস্তান্তর:

জেলা (সাবেক মহকুমা), থানা ও গ্রাম—এই তিন স্তরভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে বর্তমানে ঢাকায় যেই ক্ষমতা এবং সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, তার বিকেন্দ্রীকরণ। এভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ প্রত্যন্ত এলাকায় হস্তান্তরিত হবে। কারণ সেখানেই স্থানীয় উন্নয়নের প্রকৃত কাজকর্ম চলছে। এ ব্যবস্থায় স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ সংগ্রহের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং স্থানীয় করসমূহ যেমন ভূমি-কর রাজস্ব, কৃষি-কর, সব ধরনের সম্পদ কর এবং পণ্যের সঙ্গে জড়িত করগুলো সংগ্রহের দায়িত্ব জেলায় অবস্থিত স্থানীয় প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। সব রাজস্ব কর্মচারী জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। অবশ্য গ্রাম সরকার এবং থানা আইআরডিপি যুক্তভাবে এ কর সংগ্রহ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করবেন। আগে থেকেই গ্রাম, থানা এবং জেলা পর্যায়ে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। যাতে তারা বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষতার সঙ্গে কর সংগ্রহ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হন। একইভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহের দায়িত্ব জেলার ওপর অর্পণ করতে হবে। জেলা কর্তৃপক্ষ সংগৃহীত শস্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদান করবে এবং বাকি অংশ গ্রাম সরকারের হাতে থাকবে। খাদ্যশস্য সংগ্রহ ব্যবস্থায় একটি কর উপাদান সংযুক্ত করে দিতে হবে, যাতে করে সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্তও উঠে আসে।

এভাবে সম্পদ সংগ্রহের অধিকারের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও স্থানীয় নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। শিল্প ইউনিট অনুমোদন করার ক্ষমতা, ঋণদানের ক্ষমতা, ভূমি ব্যবহারের ক্ষমতা ইত্যাদি সবকিছুই কয়েকটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক মাত্রার ভেতরে স্থানীয় নেতৃত্বের অধিকারে ছেড়ে দিতে হবে। জেলা পর্যায়ের শিল্পগুলোর জন্য জেলা শিল্পায়ন সংস্থার ডিস্ট্রিক্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টেট ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের হাতেই ক্ষমতা ও সম্পদ থাকবে। ফলে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের ঢাকায় এসে অর্থ ও অনুমোদনের জন্য ছোটাছুটি করতে হবে না। কিছু কিছু খুদে শিল্প ইউনিট সেক্টর করপোরেশনের হাত থেকে উদ্ধার করে জেলা প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। বিশেষ করে, যেসব শিল্পের স্থানীয় বাজার রয়েছে অথবা যেসব শিল্প স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করবে, সেগুলোকে জেলা বোর্ডের হাতে তুলে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। জেলা বোর্ডের একটি জেলা শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন থাকবে। তাদের নিজস্ব স্থানীয় ‘ইনপুট-আউটপুট ম্যাট্রিকস’ থাকবে। অবশ্য এর অর্থ এই নয়, স্থানীয় পর্যায়ে শুধু ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠিত হবে। বরং বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ সৃষ্টির কর্মসূচির অধীনে বৃহত্ শিল্পও প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি সময়ে সম্পদ ও ক্ষমতার এ বিকেন্দ্রীকরণ অনিবার্যভাবে কিছু দুর্নীতি ও অদক্ষতার সৃষ্টি করতে পারে। দক্ষ জনশক্তিকে ঠিকমতো ছড়িয়ে দিতে পারলে, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারলে কুফল কিছুটা হ্রাস পাবে। তবুও এ ব্যবস্থায় কিছু ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য এ ব্যবস্থায় সরকার ও উন্নয়ন ক্রিয়াকাণ্ডের ওপর জনগণের প্রত্যক্ষ নজর রাখার সুযোগ রয়েছে। তদুপরি এসব সংস্থার কার্যকলাপ ও ফলাফলের ওপরেই এসব সংস্থার কর্মরত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, অবনতি ইত্যাদি নির্ভর করবে। এসব কারণে স্থানীয় জনগণই স্বীয় স্বার্থের প্রকৃত পাহারাদার হতে পারত, আবার একইভাবে দক্ষ অফিসারদের গ্রাম পর্যায়ে নিয়োগ করলে তাদের ওপর বৃহত্তর কাজের চাপ যেমন সৃষ্টি করবে, তেমনি প্রচুর উদ্দীপনাও সৃষ্টি করবে। কারণ সেই পর্যায়ে তারা তাদের কাজের ফলাফল নিজেরাই প্রত্যক্ষ করতে পারবেন এবং তাদের কর্মদক্ষতার একটি সঠিক পরিমাপ সম্ভব হবে।

এ সংস্কারের ফলে সরকারের সঙ্গে প্রান্তের এবং গ্রামের সঙ্গে শহরের ব্যবধান কমবে। উত্পাদনশীল সম্পর্ককে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উত্পাদনের প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা দেয়ার ফলে লুক্কায়িত ‘উদ্যোক্তা’ (Enterpreneurial) দক্ষতার স্ফুরণ হবে। প্রশাসন ও জনগণের এসব দক্ষতা উত্পাদনশীল খাতের দিকে প্রবাহিত হবে।

 

রেহমান সোবহান: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান