প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখতে হবে: ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in সমকাল on 23 May 2021

বেলা-আইইউসিএন অনলাইন আলোচনা

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজন নীতি সংস্কার ও বাস্তবায়ন

মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বর্তমান অতিমারি। অথচ মানুষের প্রকৃতি বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ডের ফলে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। পরিবেশকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন হবে, উন্নয়নকে কেন্দ্র করে পরিবেশকে সাজানো যাবে না। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতেই হবে। এটি আমাদের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি। উন্নয়নকে টেকসই করতে যথাযথ প্রক্রিয়া যেমন পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব নিরূপণ, জনমত গ্রহণ, পর্যালোচনা নিশ্চিত করতে হবে এবং এসব বিষয়ে আইন কঠোরভাবে মানতে হবে।

গতকাল শনিবার ‘জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশগত অবদান সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) এবং আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এ অনুষ্ঠানে আয়োজন করে। এতে মিডিয়া সহযোগী ছিল দৈনিক সমকাল।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। পরিবেশবিদ, শিক্ষক, গবেষক,  উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিকসহ দেশের নানা অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা ওয়েবিনারে যুক্ত ছিলেন।

প্রকৃতি রক্ষায় কোনো কোনো জায়গায় নীতি ও আইনে শূন্যতা আছে উল্লেখ করে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, আজকের অলোচনায় তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে অনেক সুপারিশ এসেছে। এসব সুপারিশ পরবর্তী পদক্ষেপে কাজে লাগবে। তিনি বলেন, কৃষি আইন ও নগরায়ণ নিয়ে অনেক আইন আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় আইন হলো সংবিধান। জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি রক্ষার বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট বলা আছে। তারপরও আমরা প্রাণ-প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। পরিবেশ রক্ষায় সংবিধানের ধারাসহ যে সুযোগগুলো আছে, সে অনুযায়ী রোডম্যাপ করে বাস্তবায়নে যেতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বলা হলেও বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। যারা দূষণ করে তাদের থামানো যাচ্ছে না। সাংঘর্ষিক জায়গাগুলো কোথায় এবং আইন থাকা সত্ত্বেও কেন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না- এসব দুর্বলতা একে একে ঠিক করা দরকার।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বর্তমানে উন্নয়নের যে ধারা তা ধ্বংসাত্মক, মানুষ ও প্রকৃতিবিরোধী। একটি ক্ষুদ্র লতা থেকে আবিস্কৃত হতে পারে অনেক জটিল রোগের নিরাময়। তাই প্রাণ, উদ্ভিদ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংস করে আবাসন, শিল্পায়ন করার প্রক্রিয়া রোধ করতে হবে। এসব বিষয়ে আইন কঠোরভাবে মানতে হবে। না হলে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারব না, যা আমরা সৃষ্টি করতে পারি না, অর্থনীতির নামে তা ধ্বংসের অধিকার আমাদের নেই।

প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখতে হবে। এগুলো কারা ব্যবহার করবে সেটাও নীতিমালার অংশ। প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় হচ্ছে নীতিমালার ব্যর্থতা ও বাজারের ব্যর্থতার কারণে। প্রাকৃতিক সম্পদের একটি মূল্য থাকা দরকার।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের জাতীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিন লাখ ৩১ হাজার সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৪ একর দখল হয়ে গেছে। ২৪ হাজার নদী এবং ৩৭৩টি জলাভূমির মধ্যে সব জায়গায় সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। দখল হয়ে গেছে ৭৭০টি নদীর প্রায় ৫৭ হাজার একর। বাঁধ দেওয়ার ফলে তৈরি হচ্ছে বড় পলির স্তর। ঢাকা শহরে সবুজের বিস্তার কমতে কমতে এখন ৯ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আরবান অ্যান্ড রুরাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসরাত ইসলাম বলেন, জীববৈচিত্র্যের জন্য যে নিয়ামক থাকা দরকার, তার মধ্যে অন্যতম জলাভূমি। নগরভূমি জনগোষ্ঠীর মাঝে সুষম বণ্টন হচ্ছে না। মানুষ বড় শহরে ভিড় করছে। জলাভূমি রক্ষায় আইন হলেও বাস্তবায়ন নেই। আবাসনের নামে নির্বিচারে জলাভূমি নষ্ট করা হচ্ছে। জলাভূমি রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হওয়া উচিত। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে সবার ভূমিকা রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, জ্বালানির বর্জ্য এবং জমিতে অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে সেগুলোর অবশেষটুকু খাল-বিল নদ-নদী হয়ে সাগরে মিশছে। এই নাইট্রাস অক্সাইড সাগরতলকে করে তুলছে অক্সিজেনশূন্য।

অরণ্য ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার মধ্যেও বন ধ্বংসের পরিমাণ কমেনি। সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংসের স্থান হলো চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে ৬৮ হেক্টরের একটি বনে ১১৩ প্রজাতির গাছপালা পেয়েছি। উন্নয়ন করলেও বন্য প্রাণীর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মো. জাহিদ বলেন, বর্জ্য মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোথায় কোন জায়গার মাটিদূষণ হচ্ছে, তা বের করতে হবে। মাটির স্বাস্থ্যরক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার, জনসাধারণকে সচেতন করে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, নীতিমালা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তিনি।

উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের পরিচালক, গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ কৃষিজমির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১৫’ চূড়ান্ত করা, জাতীয় প্রাণবৈচিত্র্য দলিল গড়ে তোলা, জাতীয় প্রাণবৈচিত্র্য নীতি গ্রহণ, জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ অনুযায়ী জীববৈচিত্র্যের সংজ্ঞায় মানুষকে যুক্ত করার সুপারিশ করেন। এ ছাড়া দেশের সব কৃষি প্রতিবেশ, হাইড্রোলজিক্যাল রিজিয়ন ও বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট এরিয়ার বাস্তুসংস্থান ও বৈচিত্র্য সুরক্ষায় আঞ্চলিক গবেষণা এবং সুরক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলার কথাও বলেন তিনি।

আইইউসিএন, বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি রাকিবুল আমিন বলেন, আইপিবিইএস একটি স্বাধীন আন্তঃসরকারি সংস্থা, ১৩০টির বেশি দেশের সরকার যার সদস্য। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত আইপিবিইএস পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য, বাস্তুসংস্থান ও মানুষের জীবনে প্রকৃতির অবদানবিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন নীতিনির্ধারকদের কাছে সরবরাহ করে। এর পাশাপাশি এই সংস্থা প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো রক্ষা, টেকসই ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও বিকল্পগুলো তুলে ধরে।

আন্তঃসরকার বিজ্ঞাননীতি পল্গ্যাটফর্ম কার্যক্রমের বৈশ্বিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সারমর্ম তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার (২০০৫ সালে সহস্রাব্দ বাস্তুসংস্থান মূল্যায়ন প্রকাশের পর) এই প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ একটি মূল্যায়ন হাজির করেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রকৃতির অবস্থা ও ধারা এবং এর ওপর সামাজিক প্রভাব, এগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ এবং সবার জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য পদক্ষেপ বিষয়ে এই প্রথম কোনো আন্তঃসরকারি সংস্থা এমন মূল্যায়ন প্রকাশ করল। এরণ; তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকাঠামোর মাধ্যমে, যা বৃহত্তর পরিসরে অংশীজনের অংশগ্রহণে বাস্তবায়ন সম্ভব।