দেশ এখন বহুমুখী সংকটে রয়েছে – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in কালের কন্ঠ on 26 January 2023

৩৩০ পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি

ডলার সাশ্রয়ে শুল্ককর ও ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর মাধ্যমে ৩৩০ ধরনের পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণে পাঁচ মাস আগেই সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুত্সাহ করতে এসব পণ্যের শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ও ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। ট্যারিফ কমিশন গত আগস্টে এই তালিকা দিলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এই সুপারিশ কার্যকর হলে অন্তত ১০০ কোটি ডলার (১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) সাশ্রয় হতে পারত বলে মনে করছেন বিটিটিসির কর্মকর্তারা।

ডলারসংকটে চাহিদা মতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে রিজার্ভে চাপ পড়ার পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও করতে হচ্ছে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার বিলাসদ্রব্যের আমদানি সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি কৃচ্ছ সাধনে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডলারের মজুদ ধরে রাখতে বিলাসীপণ্য আমদানি নিরুত্সাহ করার কথাও বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।

আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বাজেটের আগে গত ২৪ মে বিভিন্ন খাতের ১৩৫টি পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক বসানো হয়। এসব পণ্যের ওপর সর্বনিম্ন ৩ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ হারে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) আরোপ করা হয়েছে।

কেন শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব
বিটিটিসি বলেছে, যেসব পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ালে শিল্পোত্পাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই, সেসব পণ্যের আমদানি সাময়িকভাবে বাড়তি শুল্কারোপের মাধ্যমে নিরুত্সাহ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব ভোগ্য পণ্য সমাজের উচ্চ ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণি ভোগ করে, সেসব পণ্যের শুল্কহার বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তালিকায় আছে—বিদেশি ফল, স্বর্ণ, মদ-বিয়ার, স্মার্টফোন, গাড়ি, মসলাজাতীয়সহ ৩৩০ পণ্য।

এসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত বছরের আগস্টে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। প্রতিবেদনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় ও আমদানি ব্যয়ে লাগাম টানতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অত্যাবশ্যকীয় নয়—এমন পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ কিংবা বন্ধ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত ২০ জুলাই বিটিটিসিকে নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্যারিফ কমিশন তিন সদস্যের কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়।

ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবু রায়হান আল বেরুনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানির চাপ কমাতে ৩৩০টি পণ্যের শুল্ক, ট্যারিফ ভ্যালু বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। এই তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেটি যাচাই-বাছাই করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হয়েছে বলে আমি জানি। মার্কেট ইকোনমিতে ভারসাম্য আনতে সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগস্টে ট্যারিফ কমিশন তালিকা পাঠিয়েছিল, সেটি এনবিআরে পাঠানো হয়েছে। এখন এনবিআর এটি বাস্তবায়ন করবে।’

এনবিআরের শুল্ক বিভাগ সূত্র জানায়, আমদানি কমলে রাজস্বের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা করার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পণ্যে শুল্কহার বাড়ানো-কমানোর প্রস্তাব যখন আসে, তখন তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখেন। শুল্কহার কমানো-বাড়ানোর সময় স্থানীয় উত্পাদন বাধাগ্রস্ত হয় কি না সেটাও এনবিআর বিবেচনা করে। আমরা আমদানি বন্ধ করতে পারব না, শুল্ক বাড়িয়ে তাদের নিরুত্সাহ করছি। আগেও যেগুলোর শুল্কহার বাড়ানো দরকার পড়েছে সেগুলো বাড়িয়েছি, প্রয়োজনে আরো বাড়াব।’

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে ডলারসংকট মোকাবেলায় বিলাসপণ্য বিশেষ করে প্রসাধনী, ফার্নিচার ও ফল আমদানির ওপর এরই মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমাদের অপ্রয়োজনীয় অনেক এলসি হয়েছে। আমদানির মাধ্যমে অনেক ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। এখন আমরা সব আমদানিতে খুব নজরদারি করছি, এতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটাই কমেছে।’

রোজা-ঈদে আরো বাড়বে আমদানি
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি দায় কমানোর নানা পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য এলসি খোলার শর্তও কঠোর করা হয়েছিল। এতে গত অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমদানির নতুন এলসি ২২.৫২ শতাংশ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে নতুন এলসির পরিমাণ ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৩৪.১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এ হিসাবে নতুন এলসির পরিমাণ ৯.৯১ বিলিয়ন ডলার কমেছে।

তবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের আমদানি নিষ্পত্তি ৭.৭১ শতাংশ বেড়েছে। আর্থিক মূল্যে এই নিষ্পত্তি বাড়ার পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বরে আসন্ন রমজান উপলক্ষে পণ্য আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে, যা ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে তিন হাজার ২৪৭ কোটি ডলারে (৩২.৪৭ বিলিয়ন ডলার) নেমে এসেছে। রোজানির্ভর পণ্য আমদানি করতে লাগবে ২২০ কোটি ডলার।

সংকটেও অদরকারি পণ্য আমদানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি ৪৬ শতাংশ বেড়ে আট হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রধান ২৫ ধরনের পণ্যের আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৭০.৪১ শতাংশ। বাকি ২৯.৫৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে ‘বিবিধ’ বা অপ্রধান পণ্য আমদানির পেছনে। এককভাবে আমদানি ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত অপ্রধান পণ্য আমদানি। এই ব্যয় ছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস দেখা গেছে। আমরাও সেই প্রভাব অনুভব করছি। এই সংকট চলমান এবং আরো ঘনীভূত হচ্ছে। আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তার খরচ বেড়ে গেছে। রেমিট্যান্সেও প্রবৃদ্ধি নেই। কর্মী বেশি পাঠালেও আয় তেমন হারে আসছে না। আবার হুন্ডি খুব সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ভেতরে কমে যাচ্ছে, আবার বিদেশ থেকে আসার প্রবণতাও কমে গেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ছাড়াও মুদ্রার বিনিময় হারও প্রভাব ফেলছে। বাজারে পর্যাপ্ত ডলার নেই।’

তিনি আরো বলেন, দেশ এখন বহুমুখী সংকটে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি থাকা প্রয়োজন, যে কমিটি সংকট সমাধানে বহুমুখী নীতিমালা প্রণয়ন করবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ভবিষ্যতে রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখন থেকেই নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানি কিছুটা কমেছে, অপ্রয়োজনীয় আমদানি আরো কমাতে হবে। তবে আমদানি বেশি কমালে প্রবৃদ্ধি হবে না। যারা ডলার পাচ্ছে তারা পরিস্থিতির সুবাদে প্রচুর মুনাফার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু ছোটরা ডলার পাচ্ছে না। তাই ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ডলারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, সব জায়গায় এক রেটে নিয়ে আসতে হবে। সুদের হারের সীমা তুলে নিতে হবে।’