বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশারও বেশি – অধ্যাপক রেহমান সোবহান

শৃঙ্খলমুক্তির দিন, বিজয়ের দিন

Originally posted in সমকাল on 16 December 2021

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। বর্তমানে গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের অর্জন এবং করণীয় নিয়ে মতামত দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন

বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি আজ। আপনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন অত্যন্ত কাছ থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর দর্শন কী ছিল?

রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণের শেষে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনগণের সামনে এ ঘোষণাই ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে তার দর্শন। তিনি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকে কল্পনা করেছিলেন একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে, যা ছিল সহজে বোধগম্য একটি লক্ষ্য এবং যা অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে উৎসাহ দিয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল সংক্ষিপ্ত এবং একই সঙ্গে সুদূরপ্রসারী। এটি শুধু পাকিস্তানি শাসনের অন্যায্য প্রভাব থেকে নয়, শতাব্দীকাল ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, তা থেকে মুক্ত করার মিশন ছিল। রক্তক্ষয়ী জন্মের আঘাত সামলে বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে এর অর্থনীতিকে অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে এবং অধিকতর বিশ্বায়িত পৃথিবীতে নিজের অবস্থান পুনর্গঠন করেছে। এসবের অনেক কিছুই হতো না, যদি আমরা স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে জনগণের পুনর্জাগরণ ঘটাতে না পারতাম, প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলতে পারতাম এবং বিশ্ব দরবারে নিজেদের তুলে ধরতে না পারতাম। বিরূপ পরিস্থিতিতে সীমিত সম্পদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে এ ধরনের পুনর্জাগরণ দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধু কি একটি কার্যকর রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে যেতে পেরেছিলেন?

রেহমান সোবহান: স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র- এই চার মূলনীতির মাধ্যমে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেন, যা পরবর্তীতে তার বীরোচিত নেতৃত্বে একটি কার্যকর জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে ধাবিত হয়। তিনি যেটুকু সময় পেয়েছিলেন, তাতে একটি কার্যকর রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ অসমাপ্ত থেকে যায়।

আপনি বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে ও পরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনামূলক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন। আমরা পাকিস্তানের তুলনায় কতটুকু এগিয়েছি?

রেহমান সোবহান: মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সামষ্টিক-অর্থনীতির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। গত ৫০ বছরের যাত্রায় বাংলাদেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। বিশেষত গত ২৫ বছরে এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে গত ১০ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল পাকিস্তানের ৬১ শতাংশ কম। ২০২০ সালে এসে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি। এ ধরনের দ্রুত উত্থান সম্ভব হয়েছে উচ্চ হারের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ এবং উচ্চ মাত্রার রপ্তানি আয়ের কারণে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের দ্বিগুণ। বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত পাকিস্তানের অর্ধেক। আমরা এখন কোনোভাবেই বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর রাষ্ট্র নই। বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য- জিডিপি অনুপাত ২ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে, পাকিস্তানকে মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেইল আউটের দরকার হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন পাকিস্তানের দ্বিগুণ। মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ তার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে রাখতে পেরেছে। এ কারণে এখন আমাদের জনসংখ্যা সে দেশের চেয়ে কম। অথচ অবিভক্ত পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৫৩ শতাংশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচ বছর পিছিয়ে ছিল। এখন আমাদের গড় আয়ু অনেক বেশি। শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলে ভর্তি ও সাক্ষরতার হারে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন এগিয়ে গেছি। সম্ভবত সবচেয়ে নাটকীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে এ দেশের নারীরা। জেন্ডার উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানকে নয়, ভারতকেও পেছনে ফেলেছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে? কারা এতে বেশি অবদান রেখেছেন?

রেহমান সোবহান: স্বাধীনতার ফল হিসেবে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন এবং একই সঙ্গে সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে নিজেকে রূপান্তর ঘটিয়েছে। এক সময় আমরা প্রধানত ধানের উৎপাদন এবং অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। বর্তমানে আমাদের জিডিপিতে কৃষির চেয়ে শিল্পের অবদান বেশি এবং গ্রামের ৫০ শতাংশের বেশি আয় আসছে অকৃষি উৎস থেকে। আমাদের রপ্তানি আয়ের বড় অংশ আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যদিকে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যকে শক্তিশালী করেছে। অর্থনীতিতে এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে একটি গতিশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি, যারা শুধু তৈরি পোশাক খাত এবং করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নয়, বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে যাদের অবস্থান। যাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্রঋণ বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী গ্রামীণ নারী এবং তৈরি পোশাক খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা গ্রাম থেকে শহরে আসা নারী, অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা এনজিও, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসী এবং নতুন প্রজন্মের তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তারা।

আমাদের সীমাবদ্ধতার জায়গা কোথায়? আগামীর পথচলায় আপনার পরামর্শ কী? আমাদের কী করতে হবে?

রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধু একটি ন্যায়পরায়ণ বা ন্যায্য সমাজের স্বপ্টম্ন দেখেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি হলেও এবং দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য এবং সামাজিক বিভেদ বেড়েছে। এর মানে আমাদের উন্নয়নের, অর্জনের ন্যায্য বণ্টন হয়নি এবং বিভিন্ন সামাজিক শক্তি যারা আমাদের উন্নয়নকে চালিত করেছে, তাদের বৃহৎ অংশ সরকারের নীতি ও সহায়তায় পর্যাপ্ত মনোযোগ পায়নি। সামাজিক অসমতা শুধু নীতি ও বরাদ্দের ঘাটতির কারণে বাড়েনি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতিও এর জন্য দায়ী। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইন থাকলেও সেগুলোর কার্যকারিতা কম। নীতি থাকলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। সুশাসনের ঘাটতির কারণ একদিকে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব এবং অন্যদিকে সরকারের নীতি ও কার্যক্রমে ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী এলিট শ্রেণির প্রভাব। এ ধরনের প্রবণতা দেশে ঋণখেলাপি সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করছে, সড়ক নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে সরকারের আইনকানুন ও বিধি কার্যকরে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে ভবন নির্মাণ ও পরিবেশ রক্ষার যথাযথ নিয়মকানুন প্রণয়ন ও পরিপালন করা হচ্ছে না। সরকারের ক্রয় ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে পুরোপুরি প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সরকারের ব্যয় পিছিয়ে থাকা সামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর তুলনায় ব্যবসায়ী এলিটদের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্যায্যতার মূল কারণ হলো, আমাদের গণতন্ত্রের গুণগত মানের অবনতি, আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষয়, সরকারি সেবায় সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকা এবং আইনের শাসনের ঘাটতি। নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অর্থ ও শক্তির ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্টেম্নর ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবে শোনা যাবে। যদি বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর ন্যায়পরায়ণ সমাজের স্বপ্টম্ন বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে শাসন প্রক্রিয়ায় অধিকতর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভালো উদ্দেশ্য থেকে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজের দিকে যেতে কাঠামোগত পরিবর্তনের দরকার হতে পারে, যার জন্য নতুন আইন এমনকি সংবিধানের সংশোধন দরকার, যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন হবে, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুযোগ বাড়াতে হবে এবং তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে। সম্পদের মালিকানায় তাদের অংশ আরও বাড়াতে হবে। তাদের জন্য গুণগত মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যায্য সমাজ গঠনে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্টম্ন বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক এবং সুশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। আর এর জন্য দরকার কাঠামোগত পরিবর্তন।