বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in প্রথম আলো on 6 March 2023

শক্তি কমলেও ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ

গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশসহ আটটি দেশের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছে।

জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও কোভিড ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের শক্তি কিছুটা দুর্বল করেছে। তারপরও বাংলাদেশের ‘তারকা’ অবস্থান অব্যাহত আছে।

বর্তমানে ১৬টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ে (২০২৬ সালের মধ্যে) উত্তরণ পর্যায়ে আছে বাংলাদেশসহ আটটি দেশ। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) ওই আট দেশের পরিস্থিতি নতুন করে মূল্যায়ন করেছে। সেখানে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থানের চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কোভিড ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সিডিপির সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুযায়ী, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের বেশি আছে। সিডিপির মতে, বাংলাদেশ এখনো উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার ওপর উচ্চমাত্রায় নির্ভরশীল। কোভিডের কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২০২০ ও ২০২১ সালে যথাক্রমে ২ ও ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এ তিন সূচকে নির্ধারিত মানদণ্ডের অনেক ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ।

‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশের যে আত্মশ্লাঘা আছে, তা বাড়তি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারে’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সদস্য, জাতিসংঘের সিডিপি

এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় থাকা অন্য কোনো দেশের এমন সাফল্য নেই।

সিডিপির মানদণ্ড অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণে মাথাপিছু আয় সূচকে একটি দেশের নির্ধারিত মানদণ্ড হলো ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৪৭৭ ডলার। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে বলে মনে করে সিডিপি। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্টের ওপরে থাকতে হয়।

এ সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৭ দশমিক ৩ পয়েন্ট। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে ‘স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি’ বলে উল্লেখ করেছে সিডিপি। আর জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হয়। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৬ দশমিক ৬ পয়েন্ট। এই সূচকে ‘কিছুটা অগ্রগতি’ আছে বলে মনে করে সিডিপি।

জানতে চাইলে জাতিসংঘের সিডিপির সদস্য ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। যদি কোনো নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে যেখানে আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়ার সুযোগ আছে, তা যেন দ্রুত চাওয়া হয়। এ ছাড়া নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য ঘন ঘন তথ্য–উপাত্ত (হাই ফ্রিকোয়েন্সি ডেটা) দরকার। বাংলাদেশে এ তথ্য–উপাত্তের বড় ঘাটতি রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে সমন্বয় ও নৈপুণ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশের যে আত্মশ্লাঘা আছে, তা বাড়তি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারে।

অন্য দেশগুলোর কী অবস্থা

আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো ‘সবুজ’ অবস্থানে থাকলেও চারটি দেশ হলুদ অবস্থানে চলে গেছে। দেশগুলো হলো ভুটান, নেপাল, অ্যাঙ্গোলা ও সোলোমন আইল্যান্ড।

ইতিমধ্যে অ্যাঙ্গোলা তাদের উত্তরণ প্রক্রিয়া নিজেরা আবেদন করে স্থগিত করেছে। কোভিডের প্রভাবে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। তাদের মাথাপিছু আয় ক্রমে কমছে। নির্ধারিত মাত্রার মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করে অ্যাঙ্গোলা এলডিসি থেকে বের হতে চেয়েছিল। মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে পারলে অন্য দুটি সূচকে কম নম্বর থাকলেও এলডিসি উত্তরণ হওয়া যায়। কিন্তু সেই মাথাপিছু আয়ে টান পড়ায় অ্যাঙ্গোলা পিছিয়ে গেল।

অন্যদিকে সোলোমন আইল্যান্ডের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের কথা ছিল। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই অনুরোধ করেছে, এ উত্তরণের সময় আরও তিন বছর যেন পিছিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তাদের আবেদন গৃহীত হয়েছে। নেপাল ও ভুটানের অবস্থাও আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

ঋণ নিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে লাওস। দেশটির ঋণের মাত্রা জিডিপির ৭০-১০০ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২২-২৩ বছরে তাদের মুদ্রা বিনিময় হার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিডের কারণে দেশটির অর্থনীতি আরও খারাপ হয়েছে। একইভাবে ভানুয়াতু ও সাও তোমে অ্যান্ড প্রিন্সপে—এ দুই দেশের শক্তিও কমেছে।

এলডিসি সম্মেলন

কাতারের রাজধানী দোহায় গতকাল রোববার শুরু হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী জাতিসংঘের এলডিসি-৫ সম্মেলন। এই সম্মেলনে আগামী ১০ বছরে এলডিসির উন্নয়ন ও উত্তরণে কী ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন, সেই বিষয়ে আলোচনা হবে।

উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বক্তব্য দেন। একই অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দিয়েছেন। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ শীর্ষ নেতারা অংশ নিচ্ছেন।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) জন্য এটি পঞ্চম সম্মেলন। প্রতি ১০ বছর অন্তর এই সম্মেলন হয়। এবারের সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হচ্ছে।

এই এলডিসি সম্মেলনের সূত্রপাত হয় ১৯৮১ সালে। প্রথম দুবার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে, পরেরবার ব্রাসেলসে এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।