বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নির্যাতিত এতিমের মতো, দেখভালের কেউ নেই – ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in The Daily Star on Tuesday 14 July 2020

গোলাম মোর্তোজা

অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো। এ বছরের ঘোষিত বাজেট, করোনাকালে বাংলাদেশের জনমানুষের যাপিত জীবন ও অর্থনীতির নানাবিধ দিক নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

দ্য ডেইলি স্টার: অর্থনীতির নানা রকমের সূচক দেখছি। অর্থনীতির ভাষায় করোনা মহামারির এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষ কেমন আছেন? বলা হচ্ছে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে, অভুক্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আবার সরকারের সহায়তাও আছে। কিন্তু, সব কিছু মিলিয়ে সাদাচোখে আমরা দেখছি মানুষ ভালো নেই। আপনার দেখার সঙ্গে আমাদের এই দেখাটার কতটা মিল বা অমিল আছে?

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতি কোনো সর্বাঙ্গীণ একক সূচক দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। একক সূচক যেহেতু সব বিষয় প্রকাশ করে না, তাই আমরা একাধিক সূচক দিয়ে তার শক্তি-সামর্থ্য বিচার করি। বর্তমান পরিস্থিতিকেও সেভাবেই দেখতে হবে।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে— বড় মাপের যেসব সূচক আছে, যেমন: প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, অনেক সময় রপ্তানি বা বৈদেশিক মুদ্রা, নির্দিষ্ট সময়ের পরে পাওয়া যায়। কোনোটা এক মাস পরে, কোনোটা ছয় মাস পরে। কিন্তু, তাৎক্ষণিকতা বিচার করার জন্য যে ধরনের সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সূচক আছে, তা খুব একটা কাজে দেয় না। কারণ, সরকারি সূচকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু, নীতি প্রণয়নের জন্য বা কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাৎক্ষণিকতা বিচার করতে আমাদের কিছু বিকল্প সূত্র ব্যবহার করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়নের দুই ধরনের বিষয় আছে। প্রথমত, যেহেতু আমাদের কাছে অর্থনৈতিক তত্ত্ব আছে, সে অনুযায়ী কিছু সিদ্ধান্তে আসতে পারি। যদি অনেক দিন ধরে দোকানপাট বন্ধ থাকে, সেই উদ্যোক্তা পুঁজি হারাবেন, কর্মসংস্থান করতে পারবেন না এবং নিজেও এক সময় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারেন। এই সিদ্ধান্তগুলো আসে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতার ভিত্তিতে। অর্থনীতি শিখিয়েছে চাহিদা না থাকলে উৎপাদন হবে না। আর উৎপাদন না থাকলে বিনিয়োগও হবে না। অর্থনীতির সূত্রে যদি দুটি ঘটনা বিচার করি, তাহলে সে অনুযায়ী তৃতীয় ঘটনায় আমরা যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসতে পারি।

দ্বিতীয়ত, বড় ধরনের জাতীয় তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর না করে আমরা কিছু দ্রুত জরিপ করতে পারি। সেটা আমরা দুইভাবে করি। একটি করি প্রকৃত তথ্য নিয়ে। বেশ কিছু বাড়িতে গিয়ে বা টেলিফোন করে জেনে নেই যে তারা কতদিন কাজে যান না, এ মাসের বেতন পেয়েছেন কি না ইত্যাদি। এর মাধ্যমে বিকল্পভাবে একটি পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে নেওয়া হয়। আরেকটি হচ্ছে পরিসংখ্যান ছাড়া মনোভাবের মূল্যায়ন করা। অর্থাৎ, আপনি কি মনে করছেন, আপনি আগের চেয়ে খারাপ আছেন? আপনি কি মনে করছেন আগের চেয়ে এখন বাজার করার জন্য আপনার হাতে কাঁচাপয়সা কমে গেছে? একজনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ আগের চেয়ে বেড়েছে, কমেছে নাকি অপরিবর্তিত আছে— তার ওপর নির্ভর করে হিসাব করা।

স্টার: গত তিন-চার মাসে এরকম কিছু জরিপ আমরা দেখেছি। একজন সচেতন নাগরিক এবং অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনার দেখা সেই জরিপের চিত্র এবং আপনি এতক্ষণ যা বললেন, তা মিলিয়ে কি বর্তমান সময়ের বিশ্লেষণ করা যায়?

ড. দেবপ্রিয়: অবশ্যই করা যায়। কোনো বিশ্লেষণই শতভাগ সঠিক হয় না। তবে, এটা বাস্তবতার কাছাকাছি গেলে আমাদের নীতি ব্যবস্থা গ্রহণ সহজতর হয়। নীতি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে বলে আমি মনে করি।

জাতীয় তথ্য যদি অর্থনীতির নীতিমালার ভিত্তিতে প্রয়োগ করি, তাহলে কী পাই? সিপিডির গবেষণা থেকে দারিদ্র্যের মাত্রা হিসাব করে যদি মনে করি, দারিদ্র্যসীমার ওপরে যারা ছিলেন তাদের ১০ বা ২০ শতাংশের আয় এই সময়ে কমে গেছে। তাহলে দেখা যায় আরও দুই থেকে তিন কোটি মানুষ এই সময়ের মধ্যে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছেন। আবার শ্রমের হিসাবে, যারা খণ্ডকালীন কাজ করেন বা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চুক্তিবিহীন কাজ করেন, তারা কাজ থেকে বিরত থাকলে কী হবে? দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ কর্মসংস্থানের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।

বিভিন্ন টেলিফোন ভিত্তিক জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে যে, কতটি প্রতিষ্ঠান খোলা আছে, কতজন বিদেশ থেকে ফিরে আসলেন, কতজন গ্রামে চলে গেলেন। সর্বোপরি অবস্থা দেখা যাচ্ছে মানুষের মনোভাবে। আগে আমরা প্রথাগত দরিদ্র মানুষকে নিয়ে এগুলো মূল্যায়ন করতাম। যদি কারো প্রতিদিন চলার জন্য দুই ডলার বা দেড় শ টাকা থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার ভেতরে আছেন। যদি তার আয় দেড় শ বা দুই শ টাকার ওপরে হয়, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকে। যাদের দৈনিক আয় দুই শ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে, তাদের এখন দরিদ্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এটাই হলো নতুনত্ব।

বাংলাদেশে যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ ছিল, তা বেড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। খানা জরিপ এখনো না হওয়ার কারণে ‘আশঙ্কা’ বলছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এটা বের করতে পারব। অর্থনীতিতে যখন আমাদের প্রত্যক্ষ সূচক না থাকে, তখন ব্যবহার করি প্রক্সি ইনডিকেটর বা বিকল্প সূচক। রোগের ক্ষেত্রে যেমন উপসর্গ দেখে বোঝা যায়, তেমনি আমরাও উপসর্গ ব্যবহার করি অর্থনীতির ক্ষেত্রে। বাজারে যদি চাহিদা কমে যায়, তাহলে আমরা বুঝি যে মানুষের হাতে অর্থ নেই। এজন্যই সরকার মুদ্রানীতির মাধ্যমে তাদের হাতে অর্থ দেওয়ার চেষ্টা করে। শুধু মুদ্রানীতি না, অনেক সময় প্রত্যক্ষভাবেও অর্থ হস্তান্তরের চেষ্টা করে সরকার। বর্তমানে সরকারের যে প্রচেষ্টা, তা দিয়েই তো প্রকাশ পায় যে পরিস্থিতি এক ধরনের সংকটপূর্ণ বলে সরকার অনুধাবন করছে।

স্টার: দেশে যদি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ থাকে, তার সঙ্গে আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষের দরিদ্র হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে পরিস্থিতি তো বেশ নাজুক।

ড. দেবপ্রিয়: আমরা যখন মূল্যায়ন করি, তখন প্রতিকারের দিকটিও বিবেচনায় নিতে হয়। শুধু ঝুঁকির দিকটা বললে তো হবে না। নীতি ব্যবস্থার ফলাফলও আমাদের দেখতে হবে। সরকার মুদ্রানীতির মাধ্যমে কিছু প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে সংকটময় পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিরাময় হয়েছে। নিরাময় কতটা হলো তা বিবেচনায় নিতে হবে। সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে কৃষি খাত। দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ থাকলেও গ্রামীণ অর্থনীতি তথা কৃষি খাত সচল ছিল। কৃষি খাত সচল থাকায় তা অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলছে, সেই হিসাব করতে হবে। এক কথায় আমাদের সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে। কী ঝুঁকি ছিল এবং ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি কতটা নিরাময় করা গেল, তা দেখতে হবে। পরবর্তীতে নিট ফলাফল কী হলো, সেটাই হবে তখন বিবেচ্য বিষয়।

স্টার: সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকার যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, তার সঙ্গে আর্থিক খাতের বড় বড় বিশৃঙ্খলার যে সংবাদগুলো আমাদের সামনে আসে, তার সম্পর্ক কতটা?

ড. দেবপ্রিয়: ১৬ আনা। কারণ, এইরকম পরিস্থিতিতে সরকারের হাতে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে। তার একটি হচ্ছে মুদ্রানীতি। সুদের হার কমানো, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে তারল্য বৃদ্ধি, বেশি কঠিন পরিস্থিতি হলে টাকা ছাপানো মুদ্রানীতির অন্তর্ভুক্ত। তবে, মুদ্রানীতি ব্যক্তি পর্যায়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নয়। এটা কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। এই পদ্ধতিতে উদ্যোক্তা কিছু তারল্য পান। এর মাধ্যমে ব্যক্তির কাছে তারল্য যাবে, তা মনে করার কারণ নেই। ব্যক্তির হাতে তারল্য আসবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। এ জন্য সরকার বাজেট বা বাজেটের বাইরে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়। সরকার জনগণের জন্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে, নগদ অর্থ হস্তান্তর করে, ভাতার ব্যবস্থা করতে পারে, ত্রাণসামগ্রী দিয়ে প্রত্যক্ষ আর্থিক ব্যবস্থা নিতে পারে। এরকম ব্যবস্থাপনা মহামারির মতো দুঃসময়ে অনেক বেশি জরুরি।

যেসব দেশে কর আদায়ের হার বেশি, ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী, পুঁজিবাজার শক্তিশালী, টাকা পাচার না হয়ে দেশেই সঞ্চয় হয়, সেসব দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার হারও বেশি হয়। সেদিক থেকে বাংলাদেশ গত ১০ বছরে এত উন্নয়নের পরেও জিডিপির ১০ শতাংশের ওপরে করের হার ওঠেনি। যে দেশে গড়ে ছয় থেকে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, যদি পাঁচ শতাংশও হয়ে থাকে, এর মানেই তো আয় বৃদ্ধি হচ্ছে। আয় বৃদ্ধি হলেই তো মানুষের কর দেওয়ার কথা। সেই কর গেল কোথায়? এ থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে আমাদের কর ব্যবস্থার কত সমস্যা। কর না দেওয়ায় দেশের বাইরে পুঁজি পাচার বেড়েছে।

দ্বিতীয়ত, আপনার দেশের ভেতরে যদি আর্থিক কাঠামোতে জবাবদিহিতা না থাকে, তবে নির্দিষ্ট মানুষের কাছে আর্থিক সুবিধা নাও পৌঁছাতে পারে। এতে সরকারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে কাজের পার্থক্য তৈরি হয়। আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখেছি, পাঁচ লাখ মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর অনুদান আড়াই হাজার টাকা করে পৌঁছানো নিয়ে কী পরিমাণ বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক মানুষের কাছে টাকা পৌঁছাচ্ছে না।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আমার মতে নির্যাতিত এতিমের মতো হয়ে আছে। দেখভাল করার কেউ নেই। এটা দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তারাও সেই দায়িত্ব পালন করে না। এখন যখন সংকট এসেছে, তখন সরকার চেষ্টা করছে এই ব্যাংকের থেকে কীভাবে আরও সমর্থন পাবে। কিন্তু, প্রয়োজনের সময় সেই সংস্কারটা সরকার করেনি। এখন ব্যাংকের যে মন্দ ঋণ, সঞ্চয়ের ঘাটতি, পুঁজির ঘাটতি রয়েছে, তা নিয়ে সরকার প্রণোদনাও ঠিকভাবে দিতে পারছে না। দিতে পারবেও না। কারণ, যাকে টাকা দেবে তিনিও সেই টাকা আবার ঠিকভাবে ফেরত দেবে কি না, সেই দায় থেকে যাবে ব্যাংকের ওপরেই। ইতোমধ্যেই মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকের  অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। সরকারের যে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে বাজেটে, আমার মতে— সরকারের খরচ অব্যাহত থাকলে সেটা আরও বাড়তে পারে। সেটা মেটাতে ব্যাংকের থেকে ধার করতে হবে। ব্যাংকে টাকা কোথায়? তাই আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের যে সংস্কার দরকার, তা খুবই সীমিত। বিগত সাত-আট বছরের মধ্যে কোনো ধরনের সংস্কার না করার কারণে আজ যখন দুর্যোগ উৎকট ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেছে, তখন সরকার অসহায় হয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়।

স্টার: আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা ও করোনাকালের সংকটজনক পরিস্থিতিতে মেগা প্রকল্পগুলোতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে?

ড. দেবপ্রিয়: যে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে, তা বাংলাদেশের মধ্যমেয়াদি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো দু-একটি মেগা প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু, বাকিগুলো প্রয়োজন। এগুলোকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু, সমস্যা হলো— এগুলো যে প্রক্রিয়ায় অর্থায়ন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ধাপে ধাপে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে বা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো— আগামী অর্থবছরের জন্য এই জায়গাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৫০ শতাংশই এই খাতে যাচ্ছে। এই ৫০ শতাংশের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ যাবে বিদ্যুৎ, পরিবহন ও জ্বালানি খাতে। পরমাণু জ্বালানির কারণে এবার সেটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে গেছে। এটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত?

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাচ্ছেন, তা আরও অনেক দেশেই হবে, তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অবকাঠামোগত প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও মাটি কাটার কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ইতোপূর্বে। এ ধরনের কাজ এক সময় আমরা প্রচুর করেছি। এখনও আমাদের কাবিখা, টিআর’র মতো প্রকল্প রয়েছে। তবে, সমস্যা হচ্ছে যে মেগা প্রকল্পগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। কারণ, মেগা প্রকল্পগুলোতে বিদেশি শ্রমিকরাও কাজ করছেন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। কিন্তু, এই প্রকল্পগুলোকে বন্ধও করা যাবে না। তবে, দেখা দরকার ছিল প্রকল্পগুলোর গতি ব্যাহত না করে এই টাকা অন্য কোথাও ব্যবহার করা যেত কি না। স্থায়ী প্রকল্প থেকে অর্থ শিথিল করে তা অন্য জায়গায় নিতেই পারতাম। আবার সমস্যা হচ্ছে— যে অর্থ নিতে পারতাম বলে মনে করছি, সেটা ঋণের টাকা। নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্যই সেটা এসেছে। ফলে তার ওপরেও যে আমার স্বাধীনতা আছে, তা নয়।

সরকারের এসব খাতে খরচের জন্য তিনটি উপায় আছে। একটি হচ্ছে— রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা দরকার। আমি মনে করি সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের ভেতরে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ অর্থ হয় অব্যবহৃত থাকে, না হয় অকার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো বের করা সম্ভব ছিল। সরকার এবার বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এভাবে পরিবীক্ষণ করে অর্থ সাশ্রয় করেনি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে— রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। এই বছরই সেটা করা জটিল হবে। তৃতীয়ত, যেটা আছে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় সহায়। আর সেটা হচ্ছে বিদেশ থেকে ঋণ করে টাকা নিয়ে আসা। এই ঋণ যদি প্রকল্পের মাধ্যমে না এসে বাজেটের মাধ্যমে আসে, তাহলে সরকার হাফ ছাড়ার জায়গা পাবে।

এই মুহূর্তে সরকারের যে আর্থিক পরিস্থিতি, যে ব্যয়ের দায়িত্ব এবং তার আয়ের যে সামর্থ্য, তাতে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া এগিয়ে যাওয়ার বেশি সুযোগ দেখছি না। এখন পর্যন্ত সরকার প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে এডিবি, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে। এই টাকাগুলো যদি প্রকল্পের বাইরে কিছু আসত, তাহলে সরকার কিছুটা সুযোগ পেত। না হলে সরকারকে খুব কঠিনভাবে ব্যয় সংকোচনে যেতে হবে অথবা র‌্যাডিক্যাল পদ্ধতিতে আয় বৃদ্ধি করতে হবে।

স্টার: ব্যয় সংকোচনের কোনো নীতি বা পরিকল্পনা তো দৃশ্যমান নয়।

ড. দেবপ্রিয়: ব্যয় সংকোচনের সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ভর্তুকির বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা। তেল আমদানিতে বড় ভর্তুকির বিষয় ছিল। এক্ষেত্রে এখন যেহেতু ভর্তুকি দিতে হবে না, সেখানে কোনো সাশ্রয় হয় কি না, সেটা দেখার বিষয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমরা যেহেতু দেশের বাজারে দাম কমাইনি, তার মানে সরকার এখান থেকে আয় করবে। এই আর্থিক খাতটি পরিষ্কারভাবে হিসাব করার দরকার ছিল এবং বাজেটে উল্লেখ করা দরকার ছিল। আমার প্রস্তাব ছিল ওই টাকাটা সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে বোনাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া। সে সুযোগ ছিল। যদিও আমরা সেটা পারিনি। ভর্তুকি যে জনকল্যাণকর, তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে আপনি একজনকে বেঁচে থাকার জন্য অর্থ দিচ্ছেন অন্য সকলের আয় থেকে। সেক্ষেত্রে সকলকে যৌক্তিকতা বোঝাতে  হবে।

রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট এক সময়ের জন্য যদি কিছুটা যৌক্তিক হয়েও থাকে, সেটাও এখন বিবেচনার বিষয়। বেশ কয়েক বছর যাবত এটা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এটা থেকে বের হয়ে আসাটা অর্থনৈতিক বিষয় নয়, রাজনৈতিক বিষয় হয়ে গেছে। পরবর্তীতে সরকার চাপের মুখে এখান থেকে সরে আসছে। চুক্তির বরখেলাপ না করে এখান থেকে সরে আসতে কতটা সময় লাগবে, তা দেখতে হবে। তাদের আইনি দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে সরকার মৌখিকভাবে যা বলছে, কার্যকরভাবে কবে করতে পারবে, তা দেখার বিষয়। আরেকটি ভর্তুকির জায়গা কৃষি খাত। কৃষিতে অনেক সময়ই টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, কিন্তু ব্যবহার করা হয় না। আমাদের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য কৃষি একটি অন্যতম খাত। এবার দেখার বিষয় কৃষিতে বরাদ্দ ঠিকমতো ব্যবহার হয় কি না।

রাজস্ব ব্যয়ের তিনটি বড় খাত থাকে। একটি ভর্তুকি, একটি দায় শোধ এবং অপরটি বেতন-ভাতা। দায় শোধের ক্ষেত্রে সরকারের খরচ বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দায় বেড়ে যাওয়ায় তার সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। বিদেশের কাছে কিন্তু আমাদের সুদ কম। আমাদের যা সুদ পরিশোধ করতে হয়, তার বেশিরভাগই কিন্তু অভ্যন্তরীণ। রাজস্ব ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় হয়। যতটা বেতন বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে ভাতা। বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে আরও একটু সংযমী হওয়ার সুযোগ আছে কি না, তা দেখার বিষয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে এক ধরনের সংযত আচরণ আমরা দেখছি। কমানোর কথা আমি বলছি না, সংযত আচরণের কথা বলছি। এটা আমাদের দেশে এখনও আসেনি। অনেকে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলেন। কিন্তু, এখন কৃচ্ছ্রসাধনের সময় না। কৃচ্ছ্রসাধনের সময় নয় বলে বিলাসিতা বর্জন করা যাবে না, তা তো নয়। বিলাসিতা বর্জন করা আর কৃচ্ছ্রসাধন করা আমার কাছে ভিন্ন জিনিস।

স্টার: আমরা তো দেখছি বোনাসসহ সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা সরকার আরও বৃদ্ধি করছে।

ড. দেবপ্রিয়: এই অর্থবছরের জন্য এটা কোনোভাবেই সুবিবেচনা হবে না।

স্টার: আমাদের প্রবাসী খাত ও পোশাক খাত যে বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে, তা তো মোটামুটি দৃশ্যমান। অর্থনীতি এই বড় ধাক্কা কীভাবে সামলাবে?

ড. দেবপ্রিয়: দুটো খাতেই ধাক্কা ইতোমধ্যে প্রকাশ্য। এই ধাক্কা কতদিন স্থায়ী হবে এবং স্থায়ী রূপ নেবে কি না, সেটা দেখার বিষয়। করোনা পরিস্থিতি আসার আগেই প্রবাসী খাত চাপের মধ্যে ছিল। তেলের দাম কমে যাওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই জনবল স্থানীয়ভাবে নেওয়ার ফলে বিদেশি শ্রমিক কমানো শুরু হয়েছিল। সেটার সঙ্গে নতুন পরিস্থিতি যুক্ত হয়ে কী দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। বৈধভাবে ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকার বাজারে আমরা নিজেদের পুনরায় নিয়োজিত করতে পারি কি না, তা দেখার ব্যাপার রয়েছে।

স্টার: পৃথিবীতে কোথায় শ্রমবাজার আছে তা তো অজানা নয়। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আমাদের তো যাওয়ার জায়গা সীমিত হয়ে যাচ্ছে। ইতালি পরিস্থিতি তো দেখছি। শেনজেন ভিসার আওতায় নেই বাংলাদেশ। এটা সাময়িক বলা হলেও কতদিন এই ভিসায় আমাদের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকবে তা বলা যাচ্ছে না।

ড. দেবপ্রিয়: এটা কয়েক বছর স্থায়ী হতে পারে। সঙ্গে আরও যুক্ত হচ্ছে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া। শ্রমবাজারে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি একটি বড় বিষয়। যদি আমার দেশ থেকে ১২৫ জন ইতালিতে যায় আর তার মধ্যে ৩০ জনের করোনা পজিটিভ থাকে এবং তাদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট যদি ৩৩ ইউরোর বিনিময়ে কেনা বলে ইতালির গণমাধ্যমে শীর্ষ খবর হয়, তাহলে আগামী দিনে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় যাবে? যদি প্রতিনিয়ত ভাসমানভাবে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেওয়া মানুষের মধ্যে অর্ধেক বাংলাদেশি নাগরিক বলে খবর প্রচার হয়, তখন সেটা আমাদের জন্য উপকারী হয় না। এক অর্থে এটা আমাদের দেশের ব্যর্থতা। আমরা দেশের থেকে একটা সঠিক করোনা সার্টিফিকেট দিতে পারি না এবং বাংলাদেশের মানুষকে শ্রমের বাজার সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত করতে পারি না।

স্টার: তাহলে নতুন শ্রমবাজারের ধারণাই কি অমূলক হয়ে যাচ্ছে না?

ড. দেবপ্রিয়: এটা আমি পুরোপুরি মনে করি না। কারণ, পৃথিবীতে আরও কিছু কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এই গড় আয়ু বাড়ার কারণে বিভিন্ন দেশের সেবা খাতে লোক নিয়োগ হচ্ছে। আগামীতে যতই যান্ত্রিকীকরণ হোক, এই জায়গাতে মানুষের প্রয়োজন থেকেই যাবে। এই জায়গাতে ফিলিপাইন, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করে বাজার নিতে পারবে কি না, সেটা একটা বিষয়। আমি ইংরেজি, জাপানি বা অন্য ভাষা জানব কি না, কম্পিউটার চালানো শিখতে পারব কি না ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে এই বাজার। বাজেটে দক্ষতা বৃদ্ধির এই উদ্যোগ দৃশ্যমান থাকা দরকার ছিল। দুর্নীতি কমানো বিবেচনায় নিয়েই বলছি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় এক শতাংশ করে বাজেট বাড়ানো দরকার ছিল।

স্টার: যে মানুষগুলো প্রবাস থেকে ফিরে এসেছে এবং আবার কাজের জন্য যেতে পারবে না, তাদের কী হবে? এই মানুষগুলো কি উদ্যোক্তা হিসেবে শ্রমবাজারেই যুক্ত হবে? নাকি বেকার হিসেবে থেকে যাবে? এগুলো বড় বিষয়। অন্যান্য দেশেও এগুলো বড় বিষয় হিসেবে আসছে।

ড. দেবপ্রিয়: এত মানুষকে এই মুহূর্তে দেশে কর্মসংস্থানের আওতায় আনার উপায় নেই। তারা এতদিন যে আয় ও সঞ্চয় করেছিল, গরিব হওয়ার কারণে তার প্রাথমিক আয় ভোগ নিরসনে চলে গেছে। বাড়ি-ঘর তৈরি, জীবনের মান উন্নয়ন, শিক্ষা, সন্তানদের বিয়ের পেছনে খরচ করেছে। এসব করার কারণে তারা দারিদ্র্যসীমার বাইরে এসেছে, কিন্তু, তাদের এমন কোনো পুঁজি তৈরি হয়নি যা দিয়ে স্বাধীনভাবে উদ্যোক্তা হতে পারবে। এই জায়গায় তারা নীতি সমর্থন কীভাবে পাবে এবং সরকার তাদের কীভাবে নেবে, তা বিবেচনার বিষয়।

এবার আসি পোশাক খাতে। পোশাক খাতের এই ধাক্কাটা নতুন না। পৃথিবীব্যাপী এই খাতে পরিবর্তন হচ্ছে। বহুল পরিমাণে উৎপাদনে প্রযুক্তিগত যে কাঠামো, তা থেকে পৃথিবী ক্রমান্বয়ে বের হয়ে আসছিল এবং এখনও আসছে। এখন মানুষ ইন্টারনেট থেকে নিজের পছন্দের জিনিস বেছে নিচ্ছে। দোকানে যাচ্ছে না। এখন মানুষ প্রাকৃতিক সুতায় তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকছে। আগে মানুষ অল্প টাকায় পোশাক কিনে, অল্প দিন পর তা ফেলে দিত। কিন্তু, এখন টেকসই উন্নয়নের দিকে নজর দিচ্ছে। অর্থাৎ, ভোক্তার মনোভাব পরিবর্তন হচ্ছে। এতে বিপণন ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের বড় বড় কারখানাগুলো শঙ্কিত হচ্ছিল। এ জন্যই অনেকে বুটিক প্রোডাকশনে চলে গেছে। বাংলাদেশ এই পরিস্থিতির সঙ্গে কীভাবে খাপ খাওয়াবে, সেটা দেখার বিষয়। করোনা মহামারি না হলেও এটা একটা বড় সমস্যা হতো। করোনায় এই জটিলতা শুধু আরেকটু বেড়েছে।

স্টার: সারা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। এমন সময়ে সরকারি ব্যবস্থাপনার পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হলো, এর তাৎপর্য কী?

ড. দেবপ্রিয়: আমাদের বোঝার ব্যাপার হচ্ছে— এটা কি পাটকলের সমস্যা, নাকি আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানার সমস্যা। যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানার ভেতরে অনেক বেশি শ্রমিক রয়েছেন, সেহেতু এটা পাটকলের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু, আমার দৃষ্টিতে এটা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যে ব্যবস্থা, তার মৌলিক সমস্যা। পূর্বে কয়েক শ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাকে আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের জন্য। একজন মন্ত্রীকে এই সরকারের আমলেই দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয়েছে পাটকলের কারণেই। যারা বলেন রাষ্ট্রায়ত্ত কলাকারখানাকে আধুনিকায়নের জন্য আরও অর্থ দিতে হবে, তাদের মনে রাখতে হবে— দুর্নীতির জায়গা বন্ধ না করে আপনি রাষ্ট্রায়ত্ত কলাকারখানা আধুনিক করতে পারবেন না। এতে অন্য কারও দুর্নীতির আয় বিস্তৃত হবে মাত্র। এটা একটা ব্যবস্থাগত সমস্যার ভেতরে আছে।

বিপরীতে দেখেন, ব্যক্তি খাতের পাটকলগুলো তো খারাপ করছে না। বিশ্বে যে পাটজাত পণ্যের চাহিদা আছে, সে ব্যাপারে আমরা একমত। সেই চাহিদা বাংলাদেশ থেকে মেটানো সম্ভব। তাই বাংলাদেশের পাটকলকে দাঁড় করাতে হবে এবং এর ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু, জীর্ণ পাটকলগুলো পাকিস্তান আমল থেকে এসেছে এবং এখানকার শ্রমিকদের বয়সও অনেক হয়েছে। আমি কি এখন শুধু এই ২৫ হাজার শ্রমিককেই দেখব? নাকি সেই ৫০ হাজারকেও দেখব যারা কাজ পাচ্ছেন না? আমি শ্রমিকদের স্বার্থ চিন্তা করার পক্ষে। কিন্তু, সেই সঙ্গে অখণ্ড শ্রমিক স্বার্থ চিন্তা করার পক্ষে। সেখানে সেই শ্রমিকরাও থাকবেন, যারা দুর্নীতির কারণে কাজ পায়নি। তাদের কথা ভুলে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না। আর মনে রাখতে হবে, যে প্রক্রিয়াতে আপনি কাজটি করতে চাচ্ছেন, সেই প্রক্রিয়াটিই তো সঠিক না।

স্টার: তাহলে আশার আলো কোনদিকে?

ড. দেবপ্রিয়: বলা হয় সব সংকটেরই একটা ইতিবাচক দিক থাকে। গত দশক ধরে বাংলাদেশের কাঠামোতে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার যে কথাগুলো আমরা বলেছি, সেগুলোকে তথাকথিত প্রবৃদ্ধির উপাখ্যান দিয়ে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো সময় কঠিনভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। এই করোনা আমাদের চোখে নিষ্ঠুরভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ওই পরামর্শগুলো কত সঠিক ছিল। সেটা ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার, সরকারের ব্যয় কাঠামো, যে খাতেই বলেন না কেন। দেশীয় শিল্পকে যথাযথ প্রণোদনা না দিয়ে একটিমাত্র রপ্তানি খাতের ওপর পুরো জাতিকে নির্ভরশীল করে তোলার ফলাফল প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। যে দেশে ন্যূনতম সার্বজনীন সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই, সে দেশে বিকাশমান মধ্যবিত্ত অসহায় হয়ে যায়।

সুতরাং, আমি মনে করি বাংলাদেশে করোনার সুফল হচ্ছে— এতদিন আমরা যুক্তিতর্ক দিয়ে যা বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সেটা হঠাৎ করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বাংলাদেশের উচ্চবর্গের মানুষের দরজায় এসে নাড়া দিচ্ছে। আমার মনে হয়, এতে তাদের চেতনা হবে, বাংলাদেশে পরিবর্তন আনতে পারব।