বাংলাদেশ অভিজ্ঞতার নিরিখে, প্রত্যাশার আলোকে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in সমকাল on 1 January 2020

একটি অভূতপূর্ব বছর অতিক্রম করে নব সূচনার দ্বারপ্রান্তে আমরা। অতিক্রান্ত বছরের বিচ্ছেদ, বেদনা এবং সর্বোপরি অনেক মৃত্যুতে আমরা সবাই ভারাক্রান্ত। অতিমারির স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের ২০২১ সালে পথ চলতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, নতুন বছরে বাংলাদেশে আর্থসামাজিক পুনরুত্থান ঘটবে। সবাই নীরোগ ও নিরাপদ থাকবেন। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে একটি মানবিক অধিকারসম্পন্ন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে এগিয়ে যাব। তাই বিগত বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে ও নতুন বছরের প্রত্যাশার আলোকে তিনটি বড় মাপের আন্তঃসম্পর্কিত কর্তব্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

প্রথম বিষয়টি হলো- করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে পরাস্ত করে ব্যক্তিজীবনকে নিরাপদ করা, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সজীব করা এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের যত্ন নেওয়া। বলাবাহুল্য, ২০২১ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে করোনার টিকা সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, দাম নির্ধারণ ও বিতরণ। উপযুক্ত দামে ঝামেলাহীনভাবে বয়স্ক ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষ কীভাবে কার্যকর টিকা পাবে, সেটাই চিন্তার বিষয়। সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল কতখানি হয়, সেটাই দেখার বিষয়।

তবে মনে রাখতে হবে, অতিমারি কেটে গেলেও এর অভিঘাত বহুদিন আমাদের অর্থনীতিতে অনুভূত হবে। ২০২১ সালে অর্থনীতিকে তাই বেগবান করার লক্ষ্যে ঋণভিত্তিক প্রণোদনার বিপরীতে প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তার নতুন গুচ্ছ ঘোষণায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, বিশেষ করে যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাকে দিতে হবে প্রাধিকার। রপ্তানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি সামষ্টিক গুরুত্ব দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্প এবং উচ্চপর্যায়ের সেবা খাতকে জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে ফসল তোলার পরবর্তী কৃষিকর্মকে শক্তিশালী করতে হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে শক্তিশালী করার জন্য গ্রামীণ ও মফস্বলের খেটে খাওয়া মানুষের আয় বাড়াতে হবে। এর চালিকাশক্তি হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। প্রথাগত দরিদ্র মানুষের সঙ্গে বিকাশমান মধ্যবিত্তকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। চালসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি তাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

দ্বিতীয় বিষয় যা মনে রাখতে হবে তা হলো- অতিমারি-উত্তর আর্থসামাজিক পুনরুজ্জীবনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। সরকারি নীতি প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও সমন্বয় শক্তিশালী করতে হবে। অভিজ্ঞতা বলে, সঠিক সরকারি নীতি অনেক সময় দুর্বল প্রতিষ্ঠানের কারণে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয় না। এটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়বে কর আহরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে কর-জিডিপি অনুপাত গত দশক ধরে স্থবির হয়ে আছে। করের হার না বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি এবং অর্থ পাচার রোধ করতে হবে। এরই সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের ব্যয়কে দুর্নীতিমুক্ত করা অতীব জরুরি।

২০২১ সালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার গুণগতমান উন্নত করার জন্যও সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। আর ব্যক্তি বিনিয়োগকে সচল করতে অতীব প্রচণ্ডভাবে প্রয়োজন ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত ও দুর্বল পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য আর্থিক প্রাতিষ্ঠানের মৌলিক অবস্থার সংস্কার। এই পুরোনো চাহিদা নতুন বছরেও প্রাসঙ্গিক থাকবে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ জোরদার করতে ব্যবসার উচ্চ খরচ কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখতে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের বাজার ধরে রাখতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের এবং বিদেশ প্রত্যাগত শ্রমিকদের কর্মের নিশ্চয়তা তথা তাদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। এই সংশ্নিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা বিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভীষণভাবে প্রয়োজন হবে নতুন বছরে। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতিমূলক আচরণ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞার মনোভাব প্রশমিত করাই হবে মুখ্য বিষয়।

তৃতীয়ত, অতিমারি-উত্তর জনসম্পৃক্ত পুনর্গঠনকে কার্যকর করতে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ও সামাজিক জবাবদিহিতা জোরদার করার উদ্যোগ। বর্তমানে সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থানির্ভর জবাবদিহিতাকে ভিত্তি করে এগোনোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। সংসদীয় জবাবদিহিতা নিস্তেজ হয়ে রয়েছে। গণমাধ্যমের জবাবদিহিতার কার্যকরী সক্ষমতা অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং পেশাজীবীদের নেতৃত্বের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে অধিগৃহীত হয়ে গেছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন দেশের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। তাই সামাজিক জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নাগরিকদের সংগঠিত ভূমিকাকে বিকশিত প্রয়াশ হিসেবে জোরদার করতে হবে আগামী বছর।
মনে রাখতে হবে, ২০২১ সাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০২০-এর থেকে বেশি প্রতিকূল হতে পারে। এই সম্ভাব্য বৈরী পরিস্থিতিকে মোকাবিলার সামর্থ্য নির্ভর করবে অতিমারি-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ক্রিয়াশীলতার সামষ্টিক ফলাফলের ওপর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই লক্ষ্যে আমরা যে যার ভূমিকা কতটুকু পালন করতে সক্ষম হবো?