বাজেটে বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Published in কালের কন্ঠ on Monday, 4 June 2018

আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে কৌশল প্রণয়নের তাগাদা দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। আসন্ন বাজেটে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনা, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার নতুনভাবে নির্ধারণ, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোসহ একগুচ্ছ প্রস্তাবও করেছেন তিনি। তিনি অর্থবছরের শেষ সময়ে কাটছাঁট করে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এড়াতে যৌক্তিক হারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, নতুন রাজস্বের ভার না চাপানো, করদাতাদের ভোগান্তি এড়াতে প্রযুক্তিনির্ভরতায় রাজস্ব আদায়ে আগামী অর্থবছরে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারজানা লাবনী

কালের কণ্ঠ: আমরা উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছি।  সামনে নির্বাচন। অর্থনীতির এমন প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোন বিষয়গুলোর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: এ দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। সীমাবদ্ধ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করতে হবে। দারিদ্র্য দূর করতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত অর্থছাড়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট এসব চাহিদার নিরিখে প্রণীত হওয়া উচিত। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন বাজেট হওয়ায় ভবিষ্যতে ভোটার তুষ্টির চেষ্টা থাকবে। রাজনীতির সূত্রে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না তার বাস্তবসম্মত সমাধান না রেখেই অনেক প্রকল্প নেওয়ার নজির এ দেশে আছে। রাজনৈতিক সরকারের বাজেট প্রণয়নে নির্বাচনের প্রভাব পড়বেই। নির্বাচনের বছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বাস্তবায়নে গুরুত্ব না দিয়েই বড় বড় প্রকল্প বাজেটে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা থাকতে পারে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না। এতে নির্বাচনে চমক সৃষ্টি হলেও পরে মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, যা পরবর্তী সময় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। তাই চলমান ব্যয়, রাজস্ব আয় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়নে নজর দিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আগামী বাজেটে কালো টাকা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করতে ব্যবস্থা থাকতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের গত ও বর্তমান মেয়াদে প্রতি অর্থবছরেই বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। অনেক সময় অর্থমন্ত্রী দাবি করেন, যা সরকারের সফলতা।

মোস্তাফিজুর রহমান: বাজেটের আকার বাড়ানোর চেয়ে বাস্তবায়নে নজর দেওয়া উচিত। আকার বাড়িয়ে বাহবা নেওয়ার আগে ভেবে দেখতে হবে, বাজেটে যা করতে চাওয়া হয়েছে, তা করা সম্ভব হয়েছে কি না। শোনা যাচ্ছে আগামী অর্থবছরে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণীত হবে। ভেবে দেখতে হবে, ‘বড় অঙ্কের বাজেটে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারছি কি না। যা ব্যয় করতে চেয়েছি, তা পারছি কি না। সম্পদের বণ্টন ও বাস্তবায়ন সব কিছু মানসম্মত হচ্ছে কি না।’ এ দেশে বহুমাত্রিক চাহিদা আছে। সামাজিক বরাদ্দ, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ কিভাবে করা যায় তা নিয়ে আগামী বাজেটে চিন্তা করতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: বড় বাজেটে অর্থ জোগাড়ে কোন খাতে বেশি গুরুত্ব দিতে অর্থমন্ত্রীকে পরামর্শ দেবেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: সম্পদ আহরণে যে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের দরকার ছিল, সেখানে শ্লথ অগ্রগতি হয়েছে। ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) আইন ২০১২ স্থগিত করায় রাজস্ব আহরণের গতি কমেছে। অন্যদিকে আয়কর আইনও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এখনো এ দেশে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বড় ধরনের ব্যবধান আছে। বাজেটের বিনিয়োগ দর্শন, সম্পদ বণ্টন নীতির বিপরীতে কাজ করেছে। আয় বাড়াতে গেলে প্রত্যক্ষ কর আদায় ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। ভ্যাট আইন ২০১২ পরে কার্যকর হলেও অনলাইনে ভ্যাট আদায়, ই-সাবমিশন, সব ধরনের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ই-ভ্যাট কালেকশন, আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে লিয়েন ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এসব কার্যক্রম দিয়ে আয় বাড়াতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে; কিন্তু আশানুরূপ নয়, এমন মত অনেকের। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোয় সবচেয়ে মনোযোগী হতে হবে। রাজস্ব ফাঁকি রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে আর্থিক দুর্নীতি কমবে না। অর্থপাচার বাড়তে থাকবে। এনবিআরকে প্রযুক্তিনির্ভর কাজে অভ্যস্ত করতে হবে। শুধু পরিকল্পনা করলে হবে না। বাস্তবায়নও করতে হবে। আমদানি-রপ্তানিতে প্রযুক্তিনির্ভরতায় কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হলে হাজার হাজার কোটি টাকা আর্থিক অনিয়ম বন্ধ হবে। সঠিক হিসাবে ভ্যাট আদায় হবে। সারা দেশের লাখ লাখ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভ্যাট আদায় হবে। আয়করে কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না। এমন সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে যে করযোগ্য আয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন ব্যক্তি প্রযুক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করদাতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এটা অসম্ভব কিছু নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এসব ব্যবস্থা আছে। সময়ক্ষেপণ না করে আগামী বাজেটেই এসব কাজে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলেও এনবিআরের আয় বাড়ছে। এনবিআরবহির্ভূত আয় বাড়ানোয় আরো নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: অবশ্যই। আগামী বাজেটে এনবিআরের বাইরে কর ও করবহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। ফি বাড়ানো ও আদায়ে নজরদারিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর প্রয়োজন হচ্ছে। বড় অঙ্কের অর্থ রাজস্বসংক্রান্ত মামলা জটিলতায় আদায় হচ্ছে না। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী আসতে আগ্রহী হচ্ছে না।

মোস্তাফিজুর রহমান: আগামী বাজেটে যে বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে আসতে সবাইকে আগ্রহী করে তোলা। অনিষ্পত্তি হওয়া মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এক টেবিলে বসাতে হবে। কেন বিকল্প আইন কার্যকর হচ্ছে না, কেন ব্যবসায়ীরা আসছে না, সমস্যা কোথায় তা চিহ্নিত করে আগামী বাজেটে সমাধানে জোর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আইনি জটিলতায় এনবিআর হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পারছে না, যা সরকারের কোষাগারে জমা হলে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারলে আটকে যাওয়া অর্থ আদায় হবে।

 

কালের কণ্ঠ: প্রতিবছরই জতীয় বাজেটে বড় ধরনের ঘাটতি থাকছে। এ ঘাটতি কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?

মোস্তাফিজুর রহমান: ঘাটতি কমাতে আয় বাড়ানোর কৌশল নিতে হবে। সম্পদ আহরণ ও সম্পদ ব্যয়ের সঠিক প্রাক্কলন করতে হবে। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সতর্ক থাকতে হবে। সম্পদ আহরণের সক্ষমতা বাড়িয়ে সম্পদ ব্যয় সম্প্রসারণের সুযোগ বাড়াতে হবে। এনবিআর এবং এনবিআরবহির্ভূত ঘাটতির যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত হতে হবে। প্রতি অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এনবিআরের করা হিসাবে গরমিল হয়। এ হিসাব যত কম হয় সে চেষ্টা করা উচিত। প্রতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এমনভাবে বাড়ানো হয় যে বছর শেষে তা আবার সংশোধন করে কমিয়ে আনতে বাধ্য হতে হয়। এতে শুধু বাজেটের শৃঙ্খলা নষ্ট হয় না, অর্থনীতির ভারসাম্যও নষ্ট হয়। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে। তবে তা রাতারাতি হবে না। এ জন্য সময় প্রয়োজন। ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ আনতেও বাজেটে নির্দেশনা থাকতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার রেকর্ড ভালো। বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার বেশি হলে অভ্যন্তরীণ ঋণের যে চাপ বাড়ছে, তা সামাল দেওয়া যাবে। অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের দায় ও ভার বাজেটের অংশ হিসেবে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগামী বাজেট প্রণয়নকালে এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: প্রকল্প বাস্তবায়নে আপনি জোর দেওয়ার কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনার সুপারিশ কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: সাধারণত প্রতি অর্থবছরে কিছু নতুন প্রকল্প শুরু করা হয়, কিছু চলমান থাকে, কিছু শেষ হওয়ার কথা থাকে। আগামী বাজেটে যেসব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা, সেসবে দ্রুত অর্থ ছাড় করে প্রয়োজনে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সব ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়লে ব্যয়ও বাড়ে। প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি ধীর হলে অনেকে সুবিধাবঞ্চিত হয়। আগামী বাজেটে অবশ্যই প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগে মনোযোগী হতে হবে। গতি আনতে হলে মেধাসম্পন্ন পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। যোগ্য পরিচালক ঘন ঘন বদলি করা যাবে না। অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ প্রকল্পের তহবিলে দ্রুত পাঠাতে হবে। তৃতীয় কিস্তির অর্থ প্রকল্পের তহবিলে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। চতুর্থ কিস্তির অর্থ রিসোর্স কমিটির মাধ্যমে দ্রুত সরবরাহে প্রস্তুত থাকতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারির নির্দেশনা রাখতে হবে। ব্যক্তি খাত নির্ভরশীল প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে নজরদারি এবং খবরদারিতে আগামী বাজেটে স্পষ্ট নির্দেশ থাকতে হবে। বড় প্রকল্পের সঙ্গে ছোট ও মাঝারি প্রকল্পেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, গতি আনতে গিয়ে উৎকর্ষ যেন ক্ষুণ্ন না হয় সে জন্য বাজেটে দিকনির্দেশনা রাখতে হবে। প্রকল্পে ব্যবহৃত সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত নজর দিতে হবে। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে চাপ রাখতে হবে। এতে ভবিষ্যতে বৈদেশিক প্রকল্প পাওয়ার সুযোগ বাড়বে।

 

কালের কণ্ঠ: আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আপনার সুপারিশ কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: গত কয়েক বছরে কালো টাকা সাদা ও ব্যাংকের পূর্ণ পুঁজিকরণে অর্থের বরাদ্দ লক্ষ করছি। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে আগামী বাজেটে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ করছি। আগামী অর্থবছরে অবশ্যই ব্যাংকিং খাতের চলমান সমস্যার পথনির্দেশনা থাকতে হবে। এসব নির্দেশ বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। ব্যাংক খাতের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকতে হবে। ব্যক্তিবিশেষের কর্মকাণ্ডের কারণে উদ্ভূত ক্ষতি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই দোষীদের জন্য আগামী বাজেটে কঠোর আইন ও আইনি প্রয়োগ রাখতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: শোনা যাচ্ছে, আগামী বাজেটেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে।

মোস্তাফিজুর রহমান: যাঁরা নিয়মিত কর দেন না, তাঁদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অনৈতিক। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনোভাবে যৌক্তিক মনে করি না। এসব ক্ষেত্রে কঠোর আইনের প্রয়োগ থাকা উচিত। দেশ এগিয়ে নিতে আর্থিক খাতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন অত্যন্ত জরুরি।

 

কালের কণ্ঠ: সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ছে। ভবিষ্যতে এসব ক্ষেত্রে কী প্রস্তাব করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: নিরাপত্তা খাতে ব্যয় (পেনশন বাদে) জিডিপির ১.৭ শতাংশ। জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গে সমন্বয় করে এ হার ৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আগামী বাজেটে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার কথা চিন্তা করতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধকতাগুলোর বেশ কয়েকটি এখনো বিরাজমান। অনেক পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেই বলে অনেক সময় অভিযোগ পাওয়া যায়।

মোস্তাফিজুর রহমান: বাজেটে বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষভাবে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস অনেকবারই শুনেছি। কিন্তু সরকারের অন্য অনেক প্রকল্পের মতো এখানেও জটিলতা রয়েছে। বাস্তবায়নে ধীরগতি। গ্রহণ করা অনেক উদ্যোগ পরিকল্পনায়ই সীমাবদ্ধ আছে। এসব বহু পুরনো সমস্যা। আগামী বাজেটে এসব বিষয়ে নজর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

 

কালের কণ্ঠ: সরকারি নীতিনির্ধারকদের অনেকেই বিভিন্ন বৈঠকে করপোরেট করহার কমানোর কথা বলেছেন। এসব উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: করপোরেট করহার কমানোর একটি উদ্যোগ শোনা যাচ্ছে। করপোরেট করহার একবারে বেশি পরিমাণে কমানোর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। পর্যায়ক্রমে কমাতে হবে। এ হিসাবে আগামী অর্থবছরে কিছুটা হ্রাস করা যেতে পারে। আমি মনে করি না, করপোরেট করহার কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে।

 

কালের কণ্ঠ : অর্থনীতিতে গতি আনতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আনতে আগামী বাজেটে কোন কোন খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন?

মোস্তাফিজুর রহমান: বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে নজর দিতে হবে। এ জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে প্রণোদনামূলক বরাদ্দ রাখতে হবে। ভর্তুকি ও প্রণোদনা কাঠামো অর্থনীতির গতিধারার সঙ্গে সমন্বয় করে নতুনভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি খাতের সম্ভাবনা, রপ্তানির ক্ষেত্রে বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণে অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি সত্ত্বেও এনবিআর তা বাড়ানোর পক্ষে নয়। আপনি কী মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। এর সঙ্গে সমন্বয় করে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবনে খানিকটা স্বস্তি আসবে। সবচেয়ে কম স্ল্যাবের কিছু মানুষ রাজস্বসীমার বাইরে চলে গেলে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অনেক বড় মাপের করদাতাদের রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করতে সক্ষম হলে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ালে যে অর্থ কম আদায় হবে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি এনবিআরের কোষাগারে জমা হবে।

 

কালের কণ্ঠ: আগামী বাজেটে সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যুক্তিযুক্ত?

মোস্তাফিজুর রহমান: অনেক সময় বলা হয়ে থাকে সঞ্চয়পত্র কেনার সুবিধা সাধারণ জনগণ ভোগ করছে। এ বিষয়ে আমি ভিন্ন মত পোষণ করি, প্রকৃতপক্ষে বেশির ভাগ সময় সঞ্চয়পত্র ধনীরা নামে-বেনামে কিনে সুবিধা নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের হার নতুনভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে।

 

কালের কণ্ঠ: দেশি শিল্পের সেফগার্ড হিসেবে রাজস্ব বাজেটে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। চলতি ও বিগত বাজেটে ঢালাওভাবে অনেক পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে আগামী বাজেটে আপনার সুপারিশ কী? 

মোস্তাফিজুর রহমান: দেশি শিল্পের বিকাশে গুরুত্ব দিতে গিয়ে এবারের বাজেটে সম্পূরক শুল্ক যৌক্তিককরণের চেষ্টা করা হবে বলে ধারণা করছি। তা যেন বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পের উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সেদিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে।

 

কালের কণ্ঠ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান: কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।