বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in দেশ রুপান্তর  on 3 June 2022

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো। সিপিডি’র সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর অধ্যাপনা করে ২০১২ সালে অবসরের পর তিনি সিপিডিতে যোগ দেন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট, করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ

দেশ রূপান্তর : দেশের গত দুটি বাজেট করোনা মহামারীর মধ্যে হয়েছিল। এবারের বাজেটে করোনা মহামারীর ভয়াবহতা না থাকলেও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং বিশে^ অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার বিষয়টি বেশ আলোচনা হচ্ছে। আসছে বাজেটে এই বিষয়গুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : এবারের বাজেটে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আমি দেখি। কভিড থেকে অতিক্রমের বাজেট হতে হবে এটি। কভিডকালীন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা, তারা যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের পেশা বদল করতে হয়েছে, অনেকে ব্যবসায়ে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন তাদের কথা বিবেচনায় আনতে হবে। করোনার ফলে অর্থনৈতিক মন্দ অভিঘাতে যারা পড়েছেন, তাদের অর্থনৈতিক মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এই বাজেটে পরিকল্পনা রাখতে হবে। এই সময়টাতে অর্থনীতি যতটা পিছিয়েছে তা পুনরুদ্ধারে সরকারের পরিকল্পনা রাখতে হবে, বাজেটে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটা গেল প্রথম দিক।

দ্বিতীয়ত, আমরা এখন যেটি দেখছি বৈশি^কভাবে অর্থনীতি এখন একটি চাপের মধ্যে আছে। বিশ^বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, তার কারণে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং তার ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ এটা হচ্ছে দ্বিতীয় কারণ। তৃতীয় যে চাপটি ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ এর ওপর একটি চাপ দেখা যায়। এর অভিঘাত এসে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর। এবং এই অভিঘাত এসে পড়েছে আমাদের মুদ্রাস্ফীতির ওপরও। চার নম্বরে আমরা দেখি যে, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যে দুর্বলতা, সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বাজারে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের যে উদ্যোগ তার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার একটি ঘাটতি দেখা যায়। এসব জায়গাতে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙ্গা করতে হবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে এমন অবস্থা ধীরে ধীরে কমে আসবে। এর জন্য এবারের বাজেটে রাজস্ব ব্যয়, রাজস্ব প্রণোদনার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

দেশ রূপান্তর : আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে শুরুতে নাটকীয় ঘটনা কম হয়নি। সবশেষে এখন এই সেতু চালুর অপেক্ষায়। অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী হতে পারে?

মোস্তাফিজুর রহমান : আমার মনে হয়, এই সেতু বাংলাদেশের আত্মবিশ^াস বৃদ্ধির জন্য, দেশের বাইরে নিজেদের সক্ষমতা জানান দেওয়ার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলি, সেখানেও এটি একটি বড় কাজ। তাই এটি যে কেবল একটি বৃহৎ অবকাঠামো তা নয়, এর বাইরেও আরও বেশি কিছু এটা। পদ্মা সেতুর ফলে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অবদান বাড়বে। এটাকে আমি কেবল আর্থিক দিক থেকেই নয়, একে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ হিসেবেই দেখি। এটা আমাদের দেশের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন। আমি বলব যে, বাংলাদেশের একটি অংশ যা এতদিন যোগাযোগে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল, এই সেতুর মধ্য দিয়ে তা একত্রিত হবে। পুরো দেশের মধ্যে একটি সমন্বয় হবে। এটি যেমন যোগাযোগের ক্ষেত্রেও হবে আবার সামগ্রিকভাবেই হবে। পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি সমন্বিত অর্থনীতির দেশ হিসেবে সামনে এগিয়ে যাবে।

আর অর্থনীতির কথা যদি বলি, বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) দেড় থেকে দুই শতাংশ বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে পদ্মা সেতু। এই সেতুর মাধ্যমে অর্থনীতি আগের চেয়ে উন্নত হবে। নানা কর্মকান্ডের সৃষ্টি হবে। এর ফলে শিল্পপার্ক সৃষ্টি হবে। দেশের বিপণন ব্যবস্থা, বিতরণ ব্যবস্থার সুযোগ বাড়বে পাশাপাশি ব্যয় কমবে। এই সেতুর ওপর দিয়ে সড়কের সঙ্গে রেললাইনও যাবে। এগুলো সবকিছুর সমন্বিত কর্মকান্ডের ওপরই নির্ভর করবে। তখনই আমরা সুফল পাব। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় যে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় তা অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছতে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হতো। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষকরা ভালো দাম পাবেন। দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আসবে। পচনশীল পণ্য তাড়াতাড়ি আসবে। কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে যে মধ্যস্বত্বভোগী তা দূর করা সহজ হবে। কৃষকরা ন্যায্য দাম পাবেন। এ ছাড়া কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্প হবে। এটা করার মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্প গড়ে উঠবে। সেই ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু ইতিবাচক অবদান রাখবে। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে। যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া এই সেতুর মাধ্যমে একইসঙ্গে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ থাকবে। এটা তখন শুধু পরিবহন করিডর নয় অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

দেশ রূপান্তর : বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের যে সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে, এটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : আমরা পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে ও নিজেদের ব্যবস্থাপনায় করেছি। প্রকৌশলীরা এর প্রকিউরমেন্ট থেকে শুরু করে এর নির্মাণকাজও শেষ পর্যন্ত করেছেন। বাংলাদেশের যে সামর্থ্য আছে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সেটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। এই সেতু এশিয়ান হাইওয়ে ও রেললাইন লিংকেও যুক্ত হবে। এটার পরিচিতি কেবলমাত্র যে বাংলাদেশে থাকবে তা না, এর বাইরে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে চলে যাবে। এর গুরুত্ব তাই দেশের বাইরেও যাবে। সার্বিকভাবে অবশ্যই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে একটা ইতিবাচক ও উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করবে।

দেশ রূপান্তর : সময়মতো প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় বাজেট বাড়াতে হয়, আবার কাক্সিক্ষত ফলাফলও অনেক সময় পাওয়া যায় না। এতে করে অর্থ খরচের বিষয় ছাড়াও প্রকল্প ব্যয়ে অস্বচ্ছতার বিষয়ও রয়েছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : এটা সত্য যে সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় একের পর এক সময় বৃদ্ধি করা হয়। আবার সেই সঙ্গে প্রকল্পের প্রস্তাবিত বরাদ্দও বাড়তে থাকে। এটা একটি সামগ্রিক বিষয়। জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এইসব রোধ করা অসম্ভব নয়।

দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কৃচ্ছ্র সাধনের নির্দেশনা এসেছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : আমরা যদি গত দুই বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে দেখি, তবে বলতে পারি এই সময়টা ছিল লড়াই করার। করোনার অভিঘাতে বিশ^ অর্থনীতিতেই একটি ধাক্কা লেগেছে এটা সত্যি। আবার এর পরেই এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখতে হচ্ছে বিশ^বাসীকে। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগ, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এসব স্থিতিশীলতা হারিয়েছে। এটা সার্বিকভাবে প্রভাব ফেলছে। তাই সবাই এখন অতিরিক্ত ব্যয় এবং খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আমাদের সবারই উচিত অপব্যয় ও অপচয় বন্ধে গুরুত্ব দেওয়া।

দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করেছিল। সব ব্যাংকের জন্য একই হার নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু দেখা গেল এখন সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোরভাবে এটি পালন করতে পারল না কেন বলে মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : সারা বিশ্বেই কিন্তু ডলারের মূল্য ওঠানামা করছে। এক্ষেত্রে আমাদের এখানেও তাই ঘটেছে। দেখা গেল, একজন পঁচানব্বই টাকায় ডলার কিনেছে, কিন্তু এখন তিনিও চাইবেন এর চেয়ে বেশি দামে না হলেও অন্তত এই দামে বিক্রি করতে। তিনিও ক্ষতি এড়াতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত ছিল।

দেশ রূপান্তর : বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে সবকিছুর বাজারমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। এমনিতেই বাজেটের পরে দেশে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। নিত্যপণ্যের দাম জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে আসছে বাজেটে কোন দিকগুলোকে বিবেচনায় রাখতে হবে?

মোস্তাফিজুর রহমান : বাজেটের আগে থেকেই প্রতি বছর কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এটা এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার ইচ্ছা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারি বলি আর মনিটরিং যা-ই বলি এসবের ঘাটতির ফলেই এমনটা হয়। পাশাপাশি কিছু পণ্যে কর কমিয়ে আনা গেলে বাজারের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা থামানো যায়। এছাড়া পণ্যের চাহিদা অনুসারে জোগান কেমন আছে তার সঠিক হিসাব নির্ণয় করাও জরুরি। আবার মজুদদারদের কারসাজিও আছে। এসব ক্ষেত্রে সজাগ থাকা গেলে বাজার সহনীয় রাখা যায়।

দেশ রূপান্তর : আপনার পরামর্শ কী? বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

মোস্তাফিজুর রহমান : সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। কিছ ুকিছু অপ্রত্যক্ষ কর রয়েছে, এসবের পরিমাণ যদি কমিয়ে আনা যায়, তার সুফল সাধারণ লোকজন পাবে। কর আদায়ের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করতে হবে। তবে তা করতে গিয়ে যেন সাধারণের ভোগান্তি বৃদ্ধি না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া দীর্ঘদিনের পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে। কম আয়ের মানুষদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য গত বাজেটে যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, এটি এবারও অব্যাহত রাখতে হবে। কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য রয়েছে, সে সবের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনতে হবে। তাতে করে কিছুটা সাশ্রয় হবে সাধারণ লোকজনের। বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু বৃদ্ধি করাই নয়, এর ব্যবস্থাপনায়ও গুরুত্ব দিতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইসসহ, ইন্টারনেট খাতের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনতে হবে।

দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান : ধন্যবাদ।