বাজেট বাস্তবায়নের চেয়ে আইএমএফের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ও শর্তগুলো পূরণ করাটাই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in Bonik Barta on 13 April 2023

সরকারের রাজস্ব ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের চাপ কমেনি

আট মাসে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৩৮ শতাংশ ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৯৫ কোটি ডলারে

চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। একই সময়ে রাজস্বও আহরণ হয়েছে লক্ষ্যের অনেক কম।

অর্থবছরের প্রথম আট মাস শেষে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে রেকর্ড প্রায় ৭৯৫ কোটি ডলারে। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ হাতে পাওয়ার পরও রিজার্ভ নিয়ে চাপ কমেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ মাসিক রাজস্ব প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভাগগুলো ২ লাখ ৫৫ হাজার ১০২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা বরাদ্দকৃত বাজেটের মাত্র ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ৫২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, যা এ খাতে বরাদ্দের ৪৬ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬ কোটি ও পরিচালন খাতে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে রাজস্ব আয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২০১ কোটি টাকায়।

ঘাটতি বাজেট পূরণে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে লক্ষ্যমাফিক অর্থ সংগ্রহ করা যায়নি। বিদেশী উৎস থেকে চলতি অর্থবছরে ঋণ নেয়ার নিট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে নেয়া নিট বিদেশী ঋণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকায়। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে নিট ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ব্যাংক খাত থেকে ৫৫ হাজার ২৪৯ কোটি টাকার নিট ঋণ নেয়া হয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকেও এ সময়ে সরকারের নিট ঋণ বাড়েনি।

সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে বা সব সময় থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়গুলো হয়নি। এ ব্যয় করার মতো অর্থ সরকারের কোষাগারে ছিল না, এখনো নেই। একই সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিওপির ঘাটতি। রিজার্ভের অবস্থা খারাপ। তাই সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। আবার এ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে বিনিয়োগ কমেছে। আমদানি কমায় এ খাত থেকে যে শুল্ক পাওয়ার কথা সেগুলোও পাওয়া যায়নি। বাজেট বিষয়ে আমার মূল্যায়ন হলো, এটি বাস্তবায়নের চেয়ে আইএমএফের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ও শর্তগুলো পূরণ করাটাই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিত্তিতে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় হবে। এর সঙ্গে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার যে দেড় বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে আছে সেটিও জড়িত। এ মুহূর্তে সরকার একটা সংকোচনমূলক পদ্ধতির ভেতরে আছে। যদিও বলা হচ্ছে আগামী অর্থবছরের বাজেট সম্প্রসারণমূলক হবে। তবে সংকোচনমূলক পদ্ধতি কতটা পুনরুদ্ধার করতে পারে সেটাই দেখার বিষয়।’

দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের অর্থ সংগ্রহ তেমন একটা না বাড়লেও অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের চেয়েও অনেক বেশি। সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ অর্থ সুদ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও আট মাসে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয় প্রশাসনিক খাতে। যদিও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ অর্থ। প্রশাসনিক ব্যয়ের মতোই নিয়ন্ত্রিত ছিল সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো খাতের ব্যয়।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মোট ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা, এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে ১৭ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত উৎস থেকে ৪৫ হাজার ৬ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস শেষে দেখা যাচ্ছে, এনবিআরের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রার ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। একই সময়ে এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার ২৭ দশমিক ১ শতাংশ ও করবহির্ভূত উৎস থেকে লক্ষ্যমাত্রার ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে।

রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মোট রাজস্ব আদায় কমেছে দশমিক ১ শতাংশ। এ সময়ে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে তা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আয়কর ও সম্পূরক শুল্ক খাতে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। অন্যদিকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও আমদানি শুল্ক খাতে তুলনামূলক বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।

রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট সাবেক নীতিনির্ধারকরা। তাদের ভাষ্যমতে, এদিক থেকে নানা খাতের অব্যবস্থাপনা বড় একটি ভূমিকা রাখছে। আবার রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতাগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি আয়ের লক্ষ্যের সঙ্গেও রয়েছে বাস্তবতার ফারাক।

সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আয় আসবে না জেনেও রাজস্ব আদায়ের বড় লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে। কারণ ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে আয় বেশি দেখাতে হবে। ব্যাংক খাত আয়করের বড় উৎস। এ খাতের অব্যবস্থাপনার কারণে আয়কর কম আদায় হয়েছে। ব্যাংক খাত নিজেও বড় করদাতা। অন্যদিকে প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানি ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে করে সম্পূরক শুল্ক আদায় কমেছে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এনবিআর রাজস্ব ফাঁকি ধরতে পারছে না। এতেও সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়া আমাদের শুরুতে ব্যয় না করে শেষের দিকে এসে এক সঙ্গে অনেক ব্যয় করার প্রবণতা রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কিন্তু ঠিকই চলছে। তবে এর বিলগুলো শুরুতে পরিশোধ করা হয়নি। অর্থবছরের শেষের দিকে এসে এগুলো পরিশোধ করা শুরু হবে। এ কারণেও ব্যয় কম দেখা যাচ্ছে। পরিচালন ব্যয়ের একটি বড় অংশ হচ্ছে সুদ বাবদ ব্যয়। আমাদের আমদানি ও রফতানির মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশই যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্পের সরঞ্জাম ও জ্বালানি ক্রয়বাবদ। এগুলো তো পণ্য তৈরি করে রফতানিতে ব্যবহার করা যায় না। ফলে বিওপির ক্ষেত্রেও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।’

আমদানি কমায় সাম্প্রতিক মাসগুলোয় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি বেশ কমে এসেছে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এ ঘাটতির পরিমাণ কমেছে ৮৬০ কোটি বা ৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি কমার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতিতেও। তবে দেশের লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি কমেনি। বরং অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বিওপির ঘাটতি অনেক বেশি স্ফীত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি শেষে বিওপির ঘাটতি ঠেকেছে ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কমে আসার বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। আমদানি কমার কারণেই সূচকগুলো কিছুটা ভালো দেখাচ্ছে। তবে অর্থনীতিতে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান এখনো অনেক কম। রেমিট্যান্সে এখনো প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি নেই। আবার বিদেশী বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান কমে এসেছে। এ কারণে বিওপির ঘাটতি বড় হচ্ছে। বিওপির ঘাটতি ইতিবাচক ধারায় না ফিরলে অর্থনীতির ভঙ্গুরতা কাটবে না।

২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পার করেছে বাংলাদেশ। রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। বিওপির ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সংকটের পাশাপাশি এলসি খোলার শর্ত কঠোর করায় আমদানির পরিমাণ কমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশে মোট ৫৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কম আমদানি হয়েছে। আট মাসে আমদানি কমার হার ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

একই সময়ে দেশের রফতানিতে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ১৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।

বাণিজ্য ঘাটতি কমার ইতিবাচক প্রভাবে সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বিওপির রেকর্ড ঘাটতি। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। এক্ষেত্রে বিওপির ঘাটতি ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।

বিওপির ঘাটতি কমে আসতে সময় লাগবে বলে মনে করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি এখনো স্বাভাবিক ধারায় ফেরেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান নয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবারো ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়, কবে বাংলাদেশের বিওপি ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।’

তবে বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে আসাকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমদানি কমার পাশাপাশি দেশের রফতানি খাত প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। রেমিট্যান্স আয়ও বাড়ছে। আশা করছি, আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বিওপির ঘাটতিও কমে আসবে।’

দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণে আনতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই কঠোর নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিলাসপণ্যের এলসি মার্জিনের হার শতভাগে উন্নীত করা হয়। এর বাইরেও এলসি খোলায় জুড়ে দেয়া হয় নানা শর্ত। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও এলসি খোলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ফলে জুলাই থেকে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ৫৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন এলসি খোলা হয়েছে ৪৫ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের। এ হিসাবে আমদানির এলসি খোলার হার ২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমেছে। এলসি খোলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য কমলেও নিষ্পত্তি খুব বেশি কমেনি। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এলসি নিষ্পত্তির হার কমেছে মাত্র ১ দশমিক ২২ শতাংশ।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে রেকর্ড এলসি নিষ্পত্তির চাপ। এক পর্যায়ে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর খুচরা বাজারে ডলারের দাম উঠে যায় ১২০ টাকা পর্যন্ত। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ডলারের দাম বর্তমানে কিছুটা কমে এসেছে। গতকাল ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় মূল্য ছিল ১০৭ টাকা ৩৫ পয়সা। তবে কার্ব মার্কেট বা খুচরা বাজারে এখনো প্রতি ডলার ১১৩-১১৪ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।

আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। আর চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েই চলছে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন বৈদেশিক বাণিজ্যকে ঘিরে সৃষ্ট চাপ ও শঙ্কা শিগগিরই কাটবে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য ও চলতি হিসাবে যে ঘাটতি আমরা দেখেছি, সেটি নজিরবিহীন। এখন আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপে বিওপির ঘাটতি রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। এ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্নমুখী তত্পরতার কারণে আমদানি ঋণপত্র খোলা কিছুটা কমেছে। কিন্তু ঋণপত্রের নিষ্পত্তি কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিওপির ঘাটতি না কমলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর সৃষ্ট চাপ আরো বাড়বে।’