ভোক্তারা কার ঘাড়ে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা চাপাবেন – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in প্রথম আলো on 10 November 2021

বিশ্ববাজারে ডিজেলের দাম বেড়েছে, এটা বাস্তব সত্য। কিন্তু দেশের বাজারে দাম বাড়ানো হবে কি না, সেটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত; বিশেষ করে জ্বালানি তেল যখন কৌশলগত পণ্য। এর দাম বাড়লে অন্য সব পণ্য ও সেবার দামের ওপর প্রভাব পড়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত কয়েক বছর কম ছিল। এর সুফল ভোক্তারা পাননি। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তখন দাম সমন্বয় করা হয়নি। ফলে গত ৭ বছরে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ মুনাফা থেকে ভাগ নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বিপিসির তহবিল থেকে দুই দফায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে একটা প্রবণতা হচ্ছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সংস্থা থেকে লভ্যাংশ নিয়ে যায় সরকার। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বিবেচনায় রেখে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না, বিশেষত জ্বালানির মতো একটি স্পর্শকাতর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কার্যফল কী হতে পারে, সেটা ভেবেচিন্তে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন সংস্থার উদ্বৃত্ত সরকার ব্যবহার করছে, কিন্তু প্রয়োজনে ভর্তুকির সমন্বয় করছে না। লোকসান হতেই ডিজেল ও কেরোসিনের এক ধাপে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। অথচ বিপিসির লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারেরই সিদ্ধান্তের কারণে, যার দায়ভার এখন পড়ছে ভোক্তা-উৎপাদক পর্যায়ে।

করোনার নেতিবাচক অভিঘাত থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বে যখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে, তখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যে বাড়বে, সেটা অজানা ছিল না, এটা অভূতপূর্বও নয়। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ একটা দুর্যোগ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসার পর্যায়ে রয়েছে, এমন সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত সে প্রচেষ্টায় বড় বাধা তৈরি করবে। সরকারের ভর্তুকির বড় বাজেট রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম এখনই না বাড়িয়ে ভর্তুকির পুনর্বিন্যাস করা যেত। তাতে মূল্যস্ফীতির চাপে ভারাক্রান্ত স্থির আয়ের মানুষের বাড়তি আরেকটি চাপ সহ্য করতে হতো না।

ডিজেল ও কেরোসিনের এই মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির ওপর প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে অভিঘাত ফেলবে। এর গুণক ও বহুমুখী প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। করোনায় কাজ হারানো, আয় কমে যাওয়া ও নতুন দরিদ্রদের ওপর মূল্যস্ফীতির বোঝা চাপবে।

আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর সরকার বিভিন্ন ধরনের কর-শুল্ক ইত্যাদি আরোপ করে থাকে, যা আমদানি মূল্যের প্রায় ৩৪ শতাংশের সমপরিমাণ। সরকার চাইলে এগুলো হ্রাস করে দাম না বাড়িয়েই সমন্বয় করতে পারত। এক লিটার ডিজেল আমদানিতে কর ও ভ্যাট দিতে হয় ১৯ টাকার মতো। এ ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেত। ভারত ডিজেল ও পেট্রলের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্ক কমিয়েছে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য দুটির দাম কমেছে। এতে দেশটির সরকারের আয় কমলেও ভোক্তারা স্বস্তি পাচ্ছেন।

বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ একটা মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসার পর্যায়ে রয়েছে, এমন সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত সে প্রচেষ্টায় বড় বাধা তৈরি করবে। সরকারের ভর্তুকির বড় বাজেট রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম এখনই না বাড়িয়ে ভর্তুকির পুনর্বিন্যাস করা যেত। তাতে মূল্যস্ফীতির চাপে ভারাক্রান্ত স্থির আয়ের মানুষের বাড়তি আরেকটি চাপ সহ্য করতে হতো না।
ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহনমালিকেরা যে ভাড়া বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন, সেটা জানা কথা। মালিকদের চাপে গণপরিবহনের ভাড়া একবারে বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। অথচ দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলরত বাসে বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং লঞ্চভাড়া বেড়েছে ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। অনেক ক্ষেত্রে দূরপাল্লার বাসভাড়া দ্বিগুণ করেছেন বাসমালিকেরা। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির যে হার, সেটার সঙ্গে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর হার সংগতিপূর্ণ নয়। ডিজেলের খরচ যদি যানবাহন পরিচালন ব্যয়ের ৪০ শতাংশও হয়, তাহলে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে পরিবহনভাড়া ৮-৯ শতাংশের বেশি বাড়ার কথা নয়। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা ডিজেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে মুনাফা বৃদ্ধির একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। সরকার তাঁদের চাপে পরিবহনভাড়া অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। যে হারে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে ভাড়া বেড়েছে অনেক বেশি হারে।

আবার সিএনজিচালিত পরিবহনের মালিকেরাও এ সুযোগ নেবেন, নিচ্ছেন। কোনটি ডিজেলচালিত, আর কোনটি সিএনজিচালিত পরিবহন, সেটি নজরদারি কারা করবে? বাস্তবতা হলো, এ সক্ষমতা তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর নেই। দু–একটা লোকদেখানো জরিমানা-মামলা হয়তো হবে। ফলে সুযোগটা অন্যরাও নেবে। এ সুযোগে পণ্য পরিবহনের ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের মালিকেরাও ধর্মঘট ডেকেছিলেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন ব্যয়, পণ্যের দাম, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। একটা পৌনঃপুনিক অভিঘাত পড়বে সামষ্টিক অর্থনীতিতে। ভোক্তা, উৎপাদক, রপ্তানিকারক—সবার ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যরা হয়তো আর্থিক ও বিভিন্ন প্রণোদনা চাইবেন সরকারের কাছে; পাবেনও সম্ভবত। সাধারণ মানুষ কী করবে?

ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ ব্যয় বাড়বে। এখন শীতকালীন ফসল, সামনে বোরো মৌসুম। এসবেরই উৎপাদন সেচনির্ভর। বোরো উৎপাদনের ব্যয় বাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা। শুধু ধান নয়, অন্যান্য সেচনির্ভর কৃষিপণ্য আবাদেও ব্যয় বাড়বে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমনিতেই কৃষি উৎপাদনে কৃষকের লভ্যাংশ কমে যাচ্ছে। ডিজেলের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তে তাঁদের লভ্যাংশ আরও কমবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকার যদি এখন কৃষিতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি না দেয় বা সরাসরি নগদ সহায়তার ব্যবস্থা না করে, তবে এ ক্ষতি তাঁরা পোষাতে পারবেন না।

ডিজেলের সঙ্গে কেরোসিনের দামও বাড়ানো হয়েছে। কেরোসিনের ভোক্তা সমাজের একেবারে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে তাঁদের জীবনমানে। করোনাকালে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। আয় কমে যাওয়ায় খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা তাঁদের কমেছে। নতুন সিদ্ধান্তে তাঁদের অবস্থা আরও নাজুক হবে। উৎপাদনের ব্যয়ভার বাড়লে তা ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ায় সরকার সেটার ব্যয়ভার পরিবহনমালিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে।

ডিজেলের সঙ্গে কেরোসিনের দামও বাড়ানো হয়েছে। কেরোসিনের ভোক্তা সমাজের একেবারে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে তাঁদের জীবনমানে। করোনাকালে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। আয় কমে যাওয়ায় খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা তাঁদের কমেছে। নতুন সিদ্ধান্তে তাঁদের অবস্থা আরও নাজুক হবে।
পরিবহনমালিকেরা বাড়তি ব্যয়ের বোঝা এবং তার সঙ্গে আরও বোঝা যুক্ত করে তা এখন ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। কিন্তু ভোক্তারা কাদের ঘাড়ে তাঁদের এই বাড়তি বোঝা চাপাবেন? তাঁদের পকেট থেকেই বাড়তি মূল্য জোগাতে হবে। তাঁদের তো এটা অন্যের ঘাড়ে চাপানোর কোনো সুযোগ নেই। দেখা যাবে, খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য সেবা থেকে কাটছাঁট করে সেটা জোগাড় করতে হবে। ফলে তাঁদের সীমিত ক্রয়ক্ষমতার ওপরই চাপ পড়বে। আয়-ভোগ-সম্পদবৈষম্য যেখানে বাড়ছে, সেখানে তেলের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তে বৈষম্য আরও বাড়বে।

জ্বালানি তেলের মতো কৌশলগত পণ্য শুধু একটি সংস্থার হাতে একচেটিয়াভাবে রাখা ঠিক কি না, সে বিষয়েও ভাবতে হবে। বিপিসির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের সুযোগ বেসরকারি খাতেও দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হবে। এটা অবশ্য মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্তের ফলে অপেক্ষাকৃত ধনী ও ক্রয়ক্ষমতা যাঁদের বেশি, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দরিদ্র ও ক্রয়ক্ষমতা যাঁদের কম, তাঁরা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণে সামষ্টিক অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, প্রয়োজন প্রণোদনা-ভর্তুকির কাঠামোগত পুনর্বিবেচনা। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে আয়-ভোগবৈষম্য কমানো যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে ‘বণ্টনের ন্যায্যতা’ নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছিল। তাদের প্রণীত রূপকল্প-২০৪১, যার দর্শনগত ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র। সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এ ধরনের নীতি সংগতিপূর্ণ নয়, বরং সাংঘর্ষিক। সামষ্টিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে উন্নয়নদর্শনের বৈপরীত্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিতের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। একটা সুযোগ অবশ্য আছে। এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া ও পুরো বিষয় নিয়ে পুনর্ভাবনা। অর্থনীতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তার বহুমুখী অভিঘাতের তাৎপর্য বিবেচনায় নিয়ে। একটি প্রতিষ্ঠান, একটি মূল্য সমন্বয়, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো