বাড়িভাড়া দেয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন অনেকেই: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in আমার সংবাদ on Monday 29 June 2020  

তবুও মন গলছে না বাড়িওয়ালাদের!

বন্ধ আয়-রোজগার। সম্ভব হচ্ছে না বাড়িভাড়া দেয়া। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। করোনায় দীর্ঘদিন বেকারত্বের কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন।

সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য কোনো চাকরিজীবীর বেতন হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের গ্রাহক নেই। শিক্ষকদের ছাত্র নেই, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কিন্ডারগার্টেনসহ কোচিংসেন্টারগুলো। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন কমে যাচ্ছে, ছাঁটাই নীতিতে দেশের সকল প্রতিষ্ঠান।

এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গেছে। ঢাকার বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট-ডিশ বিলসহ নানা খরচে বিপর্যস্ত সবাই। কঠিন এসময়েও একটু সহানুভূতি নেই বাড়িওয়ালাদের।

পূর্ণ ভাড়া দিতে দেয়া হচ্ছে চাপ। না হয় বাসা থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। রাজধানীর গ্রিন রোডে পাঁচ বছর ধরে একটি বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়ায় থাকেন নরসিংদীর আবু সাঈদ। কাজ করেন একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে।

গত তিনমাস চাকরি নেই, বেতনও নেই। সময় চাওয়া হয় পরিস্থিতি ঠিক হলে সব ভাড়া পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু রাজি হননি বাড়িওয়ালা। চলতি মাসের ভাড়া মওকুফ করে দিয়ে জোরপূর্বক দুই মাসের ভাড়া আদায় করে তাদের বাসা থেকে বের করে দেন।

স্ত্রী-সন্তানদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আবু সাঈদ এখন ফার্মগেইটে একটি মেসে উঠেছেন। যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের বউবাজার এলাকায় থাকেন নাসরিন চৌধুরী। চারমাস আগে তিনি বিয়ে করেন। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে।

বিয়ের পর থেকে ঢাকায় থাকছেন। স্বামী একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। নাসরিন চৌধুরীও একজন শিক্ষার্থী, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়েন। স্বামীর আইটি কোম্পানি করোনা সংক্রমণের পর থেকে বন্ধ থাকায় বেতন হচ্ছে না।

তাই তিনমাস ধরে বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না তিনি। চলতি মাসে বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন এবং টাকা পরিশোধ করে বাসা ছেড়ে দিতে বলেন। একপর্যায়ে মানসম্মান হারানোর ভয়ে নাসরিন চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে বাবার বাড়ি চলে যান। সেখানে গিয়ে ঘরে জমা রাখা ধান বিক্রি করে বাড়িওয়ালার টাকা পরিশোধ করে চলতি মাসে বাসা ছেড়ে দেন। স্বপ্ন ভেঙে তিনি এখন এলাকায় থাকছেন।

এ পরিস্থিতিতে চাকরিজীবী ছাড়াও বেশি বিপাকে পড়েছে মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রায়হান হোসেন। বাংলা বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ে। লকডাউনের আগেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বাড়ি চলে যায়।

বাড়িতে থেকেও মুহাম্মদপুরে একটি মেসে দু’মাস ভাড়া দিতে হয়েছে। টিউশনি থাকায় গত মাসে ঢাকায় আসে। মাস পার হলেও টিউশনির বেতন হচ্ছে না। তাই দিতে পারছে না বাড়িভাড়া। মেসের অন্য সদস্যদেরও একই পরিস্থিতি।

গত সপ্তাহে মেসের সব সদস্য মিলে বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করে যাতে কিছু টাকা কম রাখা হয়। বাড়িওয়ালা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ভাড়া কমানো সম্ভব নয়; পূর্ণ ভাড়া দিয়ে থাকতে হবে, না হয় বাসা ছেড়ে দিতে হবে। রায়হান হোসেন জানায়, ছয়তলা বিশিষ্ট ওই বিল্ডিংয়ে ১৮টি ইউনিট। ইতোমধ্যে ১১টি ফ্যামিলি ভাড়া দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে বাসা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেছে।

রায়হান হোসেন জানায়, বাড়িওয়ালা ওই বিল্ডিংয়ের বেশ কয়েকজনের মোটরসাইকেল জব্দ করে রেখেছেন। তিনি সন্দেহ করছেন, যারা মেসে থাকছেন তারা বকেয়া টাকা  না দিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজিমপুর, মগবাজার,  মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা ও উত্তরা এলাকায় বাসাবাড়িতে অপেক্ষাকৃত বেশি বাড়ি ছাড়ছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকায় নিম্ন আয়ের ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন বেশি বসবাস করতো, সেখানে বাসা খালি হয়ে যাচ্ছে।

উপার্জন কমে যাওয়া ও অনেকের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের বাসিন্দাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে কেউ কেউ মেসে উঠেছেন। বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে তারা মালপত্র ট্রাকভর্তি করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ মালপত্র রেখেই যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের কর্মসংস্থানের বেশির ভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হতো। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসতো মানুষ।

এভাবে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় প্রায় দুই কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। এ ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর বাসার উচ্চ ভাড়া দিয়ে আসছেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসাভাড়ার চিত্র।

করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা, ফলে ছেড়ে দিচ্ছেন বাসা, ছেড়ে যাচ্ছেন ঢাকাও।

সমপ্রতি ব্র্যাকের এক গবেষণায় উঠে আসে— রাজধানীর ৮২ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ৬৮ শতাংশ মানুষ ঢাকায় বাড়ি কেনার কথা ভাবেন না। ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রে বাসাভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অনেকেরই আয় কমেছে। এ অবস্থায় বাসাভাড়া পরিশোধ করা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি, নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও বাড়িভাড়া মওকুফ করার জন্য। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছে না।

অনেক মানুষ বেকার এবং আয় কমে যাওয়ার কারণে তাদের পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর আয়ের আশায় তিনি নিজে কোনো একটি মেসে বা কম টাকা ভাড়ার বাসায় উঠেছেন। করোনা পরিস্থিতিতেও অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াদের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে ভাড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। যে কারণে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

‘বাংলাদেশ মেস সংঘ’ সংগঠনটির মহাসচিব আয়াতুল্লাহ আখতার এ বিষয়ে বলেন, করোনার এই সময়ে পুরো ঢাকাজুড়ে যারা মেসে থাকতেন তাদের অনেকেই সংকটে পড়ে গেছেন। একটি অংশ গ্রামে গিয়ে আর ফেরেননি।

তিনি দাবি করে বলেন, পুরো ঢাকার মেসের বাসিন্দাদের নিয়ে তাদের জরিপ রয়েছে। সেখানে উঠে আসে মেসের বাসিন্দা প্রায় ২৫ লাখ। তাদের মধ্যে ছাত্র, কর্মজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছে। মেসে যারা বসবাস করেন তাদের অনেকে ছোটখাটো পার্টটাইম জব করে খরচ চালান। এটাও বন্ধ। সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতি মেসমালিক ও মেসের বাসিন্দাদের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

যার বাড়িভাড়া দেয়ার সক্ষমতা ছিলো, তার এখন আর সেই অবস্থা থাকছে না। কেউ কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। এই জায়গাতে তারাই যাবেন, যারা তুলনামূলকভাবে অস্থায়ী চাকরি করতেন। খণ্ডকালীন কাজ করতেন। এটাই হলো করোনার এই মহামারিতে অর্থনীতির অভিঘাতের বড় জায়গা।