বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বন্দরের দিকে তুলনামূলকভাবে সরকারের নজর কম ছিলঃ ড. মোয়াজ্জেম

Published in যুগান্তর on Sunday, 25 March 2018

গোলটেবিল বৈঠকে অভিমত

প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছে না চট্টগ্রাম বন্দর

পরিকল্পনার অভাবে বাড়ছে সংকট * বছরে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা

চট্টগ্রাম ব্যুরো

টার্মিনাল, জেটি, লাইটার জাহাজ ও যন্ত্রপাতি (ইক্যুইপমেন্ট) সংকটসহ নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রত্যাশিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্য খালাসে দীর্ঘ সময় লাগছে। ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রফতানি। পণ্য খালাসে ধীরগতিতে শুধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, এর প্রভাব পড়ছে খুচরা পর্যায়ের ক্রেতাদের উপরও। বন্দরের এ অবস্থার জন্য রাজনৈতিক অমনোযোগিতা এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করে তারা বলেন, বন্দরের প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে হারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়ার দরকার ছিল তা হয়নি। শনিবার বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিল আয়োজিত ‘সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর, উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন।

চট্টগ্রাম ক্লাবের স্পোর্টস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন পক্ষ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমসের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট খাতের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর। বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিলের সভাপতি মো. রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের হেড অব নিউজ মামুন আবদুল্লাহর সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল (অব.) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন) জাফর আলম, চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার নাহিদা ফরিদী, বিএসএম গ্রুপের কর্ণধার আবুল বশর চৌধুরী, বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম আকতার হোসেন, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অঞ্জন শেখর দাস, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহসভাপতি আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, ট্রেইলর-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি সৈয়দ বখতিয়ার প্রমুখ।

বন্দরের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে ড. আহসান মনসুর বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ হয়। গত বছর থেকে এ বন্দরে মারাত্মক জাহাজজট দেখা দিয়েছে। একটি জাহাজের জেটিতে বার্থিং পেতে ১ থেকে ১২ দিন এবং পণ্য খালাস করতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগছে। ২০১৭ সালে বন্দরে প্রতিটি জাহাজের গড় অবস্থানকাল আগের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। বন্দরে জাহাজ আসার পরিমাণ এবং পণ্য হ্যান্ডলিং বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এ অবস্থায় আগামী বছরগুলোয় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে যে প্রবৃদ্ধি ঘটবে তা সামাল দিতে এ বন্দর আরও বড় সমস্যার মুখোমুখি হবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের যে অবস্থার কথা ব্যবহারকারীরা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে এর পেছনে পলিসিগত দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অমনোযোগ ছিল। সে জন্য বন্দরের অবকাঠামো চাহিদামতো গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অমনোযোগের একটা বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি। ফলে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, চট্টগ্রাম শহরও পিছিয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর বনাম পায়রা বন্দর এভাবে দেখার কোনো অবকাশ নেই। চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়া অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। দেশে আরও অনেক বন্দর হতে পারে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কারণ নতুন বন্দর হতে সময় লাগবে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন। প্রাকৃতিকভাবে এর অবস্থান চট্টগ্রামে হলেও সুফল পাচ্ছে সারা দেশের মানুষ। তাই বন্দরের অগ্রগতি মানে দেশের অগ্রগতি। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে বেশিরভাগ বিনিয়োগই হয়েছে সড়ক, রেল, ব্রিজ, বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতে। কিন্তু বন্দরে সে তুলনায় বিনিয়োগ হয়নি। বন্দরের দিকে তুলনামূলকভাবে সরকারের নজর কম ছিল। অথচ বন্দরকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। বন্দর ব্যবহারকারীরা তাদের দৈনন্দিন সমস্যার কথা সভা-সেমিনারে বলে যাচ্ছেন। এতে বোঝা যায় ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের দূরত্ব রয়ে গেছে। এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল (অব.) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোয়ালিটি সার্ভিস বলে যেটা বোঝায় সেটা দিতে পারছে না বন্দর। বন্দর ব্যবহারকারীরা আশানুরূপ সেবা পাচ্ছেন না বলেই এ নিয়ে কথা বলছেন।

চট্টগ্রামের বৃহৎ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের কর্ণধার আবুল বশর চৌধুরী বলেন, কোনো কোনো জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগছে। একদিন একটি জাহাজের বেশি অবস্থানের কারণে গুনতে হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রভাব খুচরা পর্যায়েও পড়ছে।

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ‘কাট অব টাইম’ বেড়ে যাওয়ায় সময়মতো পণ্য রফতানি করতে পারছেন না তারা। এ জন্য অনেক গার্মেন্ট কারখানার অর্ডার বাতিল হচ্ছে। কিন্তু যাদের জন্য এই অপূরণীয় ক্ষতি, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন) জাফর আলম বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মাণসহ অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়বে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বলা হয়, সমস্যা সমাধানে বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু উদ্যোগ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। তাই পণ্য খালাসেও আশানুরূপ গতি আসছে না। যথাযথ অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে আজ বন্দরে সংকট সৃষ্টি হতো না। দেশে আরও বন্দরের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরকে অবহেলিত রেখে নতুন বন্দরের দিকে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। আগে চট্টগ্রাম বন্দরকে গতিশীল করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই চট্টগ্রাম বন্দরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।