বিভিন্নমুখী চাপ ও ঝুঁকির মধ্যে এবারের বাজেট আসছে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in কালের কন্ঠ on 10 May 2023

আইএমএফের শর্ত পূরণে চাপ বাড়বে মধ্যবিত্তের

১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটের আকার হবে সাত লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এটি দেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট। আকারের দিক থেকে এটিই হবে দেশের বৃহত্তম বাজেট, যা আগেরটির তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।

গত সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাজেট নিয়ে আন্ত মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বাজেটবিষয়ক এ বৈঠকের বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করা হয়, যেখানে ১ জুন বাজেট উপস্থাপনের জন্য বাজেটের বইসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট প্রকাশের দিনক্ষণ নির্ধারণ এবং দায়িত্ব বণ্টনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানানো হয়। বাজেট চূড়ান্ত করতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এক বিশেষ সভা হবে।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত আরোপ করেছে। প্রধান শর্ত হচ্ছে, ভর্তুকি কমানো ও রাজস্ব বাড়ানো। এ ছাড়া সংস্থাটির অন্যান্য শর্তের মধ্যে আছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ, সুদের হার বাজারমুখী করা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, একক বিনিময় হার চালু ইত্যাদি।

আইএমএফের শর্ত পূরণে ভর্তুকি কমাতে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলে ভর্তুকি উঠে গেলে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। ফলে সরকারের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য এলেও বিপরীতে পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতির হারে বাড়তি চাপ পড়বে। এতে মধ্যবিত্তের কষ্ট আরো বাড়বে।

যদিও সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘এবারের বাজেট নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনারা ঠকবেন না।’ বাজেটে ব্যবসায়ীরা খুশি হবেন বলে জানান তিনি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির চালিকাশক্তি দেশের মধ্যবিত্ত তথা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরির নেপথ্যের এই কারিগরদের সহায়তা করা না গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গতি আসবে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বাজেটে নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে। তারা জীবনধারণের জন্য যেসব পণ্য ক্রয় করে সেগুলোর মূল্য সাধারণ মূল্যস্ফীতির চেয়ে দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয়েছে। সেটা আগামী এক-দুই বাজেটেও দূর করা যাবে বলে মনে হয় না। প্রান্তিক মানুষের জন্য সামজিক সুরক্ষায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে আরো মানুষকে এর আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট : জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করবেন আগামী ১ জুন। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন ১ জুন।

চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছিল দুই লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন এডিপির আকার হতে পারে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে ঘাটতি থাকবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫.২ শতাংশ, আকারে যা হতে পারে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়লেও স্বাস্থ্যে কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ—এ দুই খাতে মোট এডিপির প্রায় ৪৬ শতাংশ বরাদ্দ যাচ্ছে।

রাজস্ব আদায়ের চাপ: আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আদায় ০.৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। এই হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমপক্ষে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আহরণ করতে হবে। এ জন্য স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায়ের চাপ থাকবে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া আইএমএফ প্রতিনিধিদল এনবিআরের কাছে জানতে চেয়েছে, কিভাবে এবং কোন কৌশলে এই অতিরিক্ত কর আহরণ করা হবে। তাদের বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর আদায়ে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়েছে। তারা আশা করছে, নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে।

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য তা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে এনবিআরকে সংগ্রহ করতে হবে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগের অর্থবছরে সব মিলিয়ে তিন লাখ দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। সুতরাং লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে।

গত বছরের নভেম্বর থেকে রাজস্ব আদায়ে ভাটা শুরুর পর সেই ধারা অব্যাহত ছিল গত ফেব্রুয়ারিতেও। ফেব্রুয়ারিতে এসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি জানুয়ারির ৪.৯১ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে ঠেকেছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত ০.৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৩ করার শর্ত দিয়েছে। এই শর্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে আমাদের যে রাজস্ব আয় আছে, তার থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত হবে ৮.৮ শতাংশ।’

কেন মধ্যবিত্তরা গুরুত্বপূর্ণ: অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, যাঁরা নির্ধারিত আয়ের মানুষ, মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করেন, যাঁদের বেতনের বাইরে বাড়তি আয় নেই, উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাঁদের বসবাস, তাঁরাই মধ্যবিত্ত; যাঁর মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। এটা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ। নানা টানাপড়েনে মধ্যবিত্ত সংকুচিত হয়ে আসছে এবং এই প্রবণতাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব খাতে নিম্নমধ্যবিত্তরা বড় ভূমিকা রাখছে। এসএমই খাতের মাধ্যমে আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশ তারাই অবদান রাখে। কিন্তু যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশাল এই জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত হয়। যারা উচ্চবিত্ত, বড় ব্যবসায়ী, তারা দর-কষাকষি করতে পারে।

কিন্তু মধ্যবিত্তরা প্রভাবশালী গোষ্ঠী নয়। তাদের সুরক্ষায় পদক্ষেপ প্রয়োজন।’

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ভাষ্য: সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্নমুখী চাপ ও ঝুঁকির মধ্যে এবারের বাজেট আসছে। সম্পদ আহরণে যেমন চাপ, তেমনি সম্পদ বণ্টনেও অগ্রাধিকার নির্ধারণের চাপ রয়েছে। ভর্তুকির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে। বাজেটে সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে বলে মনে হচ্ছে। তাহলে আমাদের ঋণনির্ভরতা বাড়বে। প্রত্যক্ষ করে জোর দিতে হবে, এনবিআরকে জনবল, প্রযুক্তি দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। ভর্তুকি ও প্রণোদনা আমরা কোন জায়গায় দেব সেটার একটা পর্যালোচনা দরকার। অর্থনীতির চাহিদার দিকেও নজর দিতে হবে।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি চাপ বাড়াবে। মজুরির চাপও আসবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও স্লথগতি হবে বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে আরো ব্যয়সাশ্রয়ী হতে হবে। সামাজিক সুরক্ষাসহ অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের অসুবিধা যাতে কম হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা ছাড় দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে জোর দিতে হবে।’

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে কর আহরণে আমরা কিছুটা ঘাটতিতে আছি। সেখানে আইএমএফের শর্ত পূরণে রাজস্ব আহরণ বড় চ্যালেঞ্জ। করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চটজলদি সম্ভব নয়। সম্পদশালীদের ওপর কর বাড়ানো, করজালের বিস্তার ঘটানো, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের বকেয়া আদায়ে জোর দিতে হবে। কর আদায়ে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যাবসায়িক খরচ কমিয়ে এনে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুষম বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরনের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায় পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক মানের হওয়া দরকার। তাই ম্যানুয়াল কর চালানপত্রের পাশাপাশি অটোমেটেড ভ্যাট চালান প্রবর্তন করতে হবে।

জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে চার লাখ টাকা এবং মহিলা ও সিনিয়র নাগরিকদের জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছি। এ ছাড়া নিম্ন আয় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য পণ্য, সাধারণ পণ্য পরিবহন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্পের কাঁচামাল/উপকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া দরকার।