বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীলতার জন্য দরকার বহুমুখী পদক্ষেপ – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in কালের কন্ঠ on 24 May 2022

বর্তমান বিনিময়হারের অস্থিরতা ব্যবসার জন্য বা ব্যক্তির জন্য উপযোগী নয়। বৈদেশিক মুদ্রার বাজার মুদ্রাস্ফীতির প্রধান নির্ধারক। তাই মূল্য স্থিতিশীলতার জন্য একটি স্থিতিশীল বিনিময়হার গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

সরকারকেও সক্রিয় হওয়া উচিত, কারণ মুদ্রাস্ফীতির চাপ বর্তমান পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। আমদানির পরিমাণের চেয়ে ব্যয় বেশি বাড়ছে। বিলাসপণ্য আমদানি ও বিদেশভ্রমণে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা আরো ভালো করে করতে হবে, যাতে সংকটকালে কোনো অপচয় না হয়। কারণ আমাদের রিজার্ভও কমে যাচ্ছে।

এদিকে আতঙ্কিত মানুষ খোলাবাজার থেকে চাহিদার চেয়ে বেশি ডলার কিনছে, যার কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা যা আছে, তার মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেচাকেনা হয় খোলাবাজারে। এখানে ব্যবস্থাপনা করতে হলে ব্যবধান ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে বৈধ পথে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হবেন।

আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোসহ ভারত, ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও যুক্তরাজ্য ছাড়া বিভিন্ন দেশ গত কয়েক মাসে মুদ্রার মান ৫ থেকে ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেছে। এখন আমাদেরও করা হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা দেশের মূল্যস্ফীতির ওপরও চাপ ফেলছে। বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও যেহেতু আমরা বেশি আমদানি করছি, সুতরাং সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে অবশ্যই এক ধরনের চাপ পড়ছে।

বিনিময়হার ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাংলাদেশে যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি ভাসমান বিনিময়হার অনুসরণ করে, এরপরও বৈদেশিক মুদ্রার মার্কেটে অস্থিরতা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন অর্থনীতিতে ডলারের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম।

এই অবস্থায় আমার কয়েকটি পরামর্শ আছে :

১. সরকারি আমদানি, যেমন—জ্বালানির জন্য একটি পৃথক তহবিল গঠন করা উচিত। এটি কেবল সরকারি আমদানি নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দেওয়া উচিত। ব্যাংকগুলো এই পেমেন্টগুলোর জন্য কোনো লাভের মার্জিন রাখবে না। এতে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ডলারের জন্য বেসরকারি খাতের চাহিদার ওপর চাপ কমবে।

২. রপ্তানি ধরে রাখার কোটা আগামী ছয় মাসের জন্য রপ্তানিকারকদের প্রত্যাবাসিত আয়ের ৫ থেকে ১০ শতাংশে কমিয়ে আনা উচিত। তাদের পরবর্তী ছয় মাসের জন্য ব্যাক-টু-ব্যাক আমদানি পেমেন্ট ছাড়া অন্য সব কিছু এনক্যাশ করতে হবে।

৩. বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করার জন্য ব্যাংকগুলোর বর্তমান নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) অবিলম্বে ৫০ শতাংশ হ্রাস করা উচিত। বিভিন্ন ব্যাংকে সরবরাহের সুবিধার্থে বিদ্যমান এনওপির ৭৫ শতাংশ অবিলম্বে আন্ত ব্যাংক বাজারে বিক্রি করা উচিত।

৪. বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আরো এক থেকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজারে সরবরাহ করা উচিত।

৫. আন্ত ব্যাংক হারের কাছাকাছি হওয়ার জন্য টাকার অবমূল্যায়ন করা উচিত এবং বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য বাজারের হারের সঙ্গে বাস্তবসম্মত হতে হবে।

৬. বৈদেশিক মুদ্রা বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিলাসবহুল সামগ্রীর আমদানি সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

৭. রেমিট্যান্স প্রবাহ উন্নত করার জন্য সব অংশীদারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রেরকদের প্রণোদনা দেওয়ার পরও বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স আসছে না। প্রেরকদের কাছে হুন্ডি বেশি লাভজনক, কারণ এটি বৈধ পথের তুলনায় বেশি লাভ দেয় তাঁদের।

৮. কিছু বৈশ্বিক সরবরাহকারীর সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য ধীরে ধীরে ভবিষ্যতের পণ্যবাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা উচিত। আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে কাজ করার জন্য বাংলাদেশকে বাণিজ্যক্ষমতাও বাড়াতে হবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)