এই মুহূর্তে ব্যাংকের লভ্যাংশ বিতরণ বন্ধ করা উচিতঃ ড. ফাহমিদা খাতুন

Published in আমাদের সময় on Wednesday 29 April 2020

নগদ লভ্যাংশ বের করে নিচ্ছেন মালিকরা

নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় অর্থনীতি বাঁচাতে বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। প্রণোদনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ছাড় পাচ্ছে ব্যাংক খাতও। কিন্তু এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও সহায়তাপুষ্ট ব্যাংক থেকে লভ্যাংশ হিসেবে নগদ অর্থ পকেটে ভরছেন মালিকরা। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অবশ্যম্ভাবী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে লভ্যাংশ প্রদান বন্ধ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করার পরার্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউনের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য বন্ধ। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে শিল্পকারখানা, সেবা প্রতিষ্ঠান, বাজার সবকিছুই বন্ধ। অর্থনীতিতে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটি ব্যাংক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। কারণ অর্থনীতি সচল রাখতে বড় অংশ অর্থের জোগানদাতা ব্যাংকগুলো। সব খাতের ঝুঁকি ব্যাংকগুলোর ওপর পড়বে।

বাজারে পণ্য বিক্রি কমে যাওয়ায় উৎপাদনকারীদের পণ্য বিক্রি কমে গেছে। উৎপাদনমুখী শিল্পের আয় কমে যাওয়ায় নির্ভরশীল সব খাতের আয়ও কমে গেছে। এর ফলে সবাই অর্থ সংকটে পড়েছে। শিল্প নিজে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ভবন ভাড়া দিতে না পারায় ভবন মালিক ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। শ্রমিক-কর্মকর্তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এক কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে বহুপক্ষের ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের নগদ টাকার সংকট তৈরি হচ্ছে।

আবার বিদ্যমান গ্রাহকদের টিকিয়ে রাখতে নতুন ঋণ দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থের জোগানদাতা ব্যাংক। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় আমানত বাড়বে না; বরং আমানত উঠিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট চরম আকার ধারণ করবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক ও প্রাইম ব্যাংকের এমডি রাহেল আহমেদ বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে তারল্য পর্যাপ্ত রাখাই প্রধান কাজ। তাই আমরা মুনাফার পরিবর্তে তারল্য ঠিক রাখতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বলেন, লভ্যাংশ ঘোষণার বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের হাতে। এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নির্দেশনা দিলে সেটি মানতে বাধ্য ব্যাংকগুলো। দেশে কার্যরত ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯টি।

ব্যাংকের সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে বিভিন্ন নীতিতে ছাড় দিয়েছে। নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) , বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হার কমানো হয়েছে, রেপো রেট কমিয়েছে, ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) বাড়ানো এবং ব্যাংকগুলোর বিলবন্ড বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৮ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে ব্যাংকগুলোকে দিতে। এতে ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ পাবে।

কিন্তু আসন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুবিধা ভোগ করে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা নিয়ে পকেট ভরছেন উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডাররা। নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে মালিকদের পকেট ভরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের লভ্যাংশ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন ব্র্যাক ও এনসিসি ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ লভ্যাংশ প্রদান বন্ধ করেছে।

ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়িয়ে শক্তিশালী এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলার জন্য আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিভিডেন্ট প্রদান না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত এই নির্দেশনা দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তাদের উদ্দেশ্য ব্যাংক খাতকে দেওয়ালিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করতে শক্তিশালী রাখা। এর আগে ২০০৮ সালের মন্দায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শত শত ব্যাংক অর্থ সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এবারের মন্দা আরও ভয়াবহ হবে এমন আশঙ্কায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে ওই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত তুলনামূলক দুর্বল। অন্তত ১০-১২টি ব্যাংক আছে যারা এখনই বন্ধের অবস্থায়। খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতিতে জর্জরিত ব্যাংক খাত। সম্ভাব্য যে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটি হলে দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকই দেউলিয়ার পথে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এই বছর অন্তত মুনাফা প্রদান না করে ব্যাংকের মূলধন বাড়ানোর পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের ব্যাংক খাত এমনিতেই নানা সংকটে রয়েছে। সুশাসনের অভাবে দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতিতে ধুঁকছে ব্যাংক খাত। করোনায় ইতোমধ্যে তারল্য সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এই মুহূর্তে লভ্যাংশ বিতরণ ঠিক হবে না। এটি বন্ধ করা উচিত।

তিনি বলেন, মুনাফা করলে ডিভিডেন্ট দেওয়ার আইন রয়েছে। যেহেতু সামনের দিনগুলোকে অনেক ঋণ দিতে হবে এ জন্য ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত রিজার্ভ এবং তারল্য মজুদ রাখা প্রয়োজন। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে আলাপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিভিডেন্ট দেওয়ার আইনটি আপাতত স্থগিত করতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশের মতো ডিভিডেন্ট প্রদান বন্ধ করা যায় কিনা সে বিষয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে একটি পক্ষ বন্ধের বিপক্ষে প্রভাব খাটাচ্ছেন। তাদের যুক্তি, পৃথিবীর অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের ব্যাংক নয়। এখানে ৩০-৩৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক উদ্যোক্তারা। বাকি শেয়ারের মালিক সাধারণ জনগণ। ডিভিডেন্ট না দিলে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হবেন, যার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়বে।

আর ব্যাংক লভ্যাংশ না দিলে ব্যাংক নিজে এবং অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যাংক ডিভিডেন্ট না দিয়ে ওই ব্যাংকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ডিভিডেন্ট দিতে পারবে না। এতে চেইন সংকট তৈরি হবে। তবে সংকটের সময় এসব খোড়া যুক্তি না দেখিয়ে ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়াতে ডিভিডেন্ট বন্ধের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকেই। বিষয়টি দু-একদিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।