ব্যাংকে মূলধন জোগান বন্ধ করা ও এসডিজি উন্নয়ন তহবিল গঠনের প্রস্তাব সিপিডি’র

Published in বণিক বার্তা on Tuesday, 13 March 2018

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা

ব্যাংকে মূলধন জোগান বন্ধের প্রস্তাব অর্থনীতিবিদদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনগণের টাকায় প্রতি বছর ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের রেওয়াজ থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এর পরিবর্তে ব্যাংকিং খাতের অরাজকতা বন্ধ ও বিপদে পড়া ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছেন তারা। পাশাপাশি বাজেটের অর্থ বরাদ্দ-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনা ও আর্থিক খাত সংস্কারের ওপরও জোর দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব প্রস্তাব দেন অর্থনীতিবিদরা।

ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা বিরাজ করছে উল্লেখ করে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, ব্যাংকিং খাতের অরাজকতা দীর্ঘদিনের। সরকারের অনেক সফল কাজ এর ফলে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক লুটপাটকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে নতুন নতুন ঋণখেলাপি তৈরি হবে। ফলে ব্যাংকগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। জনগণের টাকায় ব্যাংকের মূলধন জোগান দেয়ার যে রেওয়াজ, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এম সাইদুজ্জামানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারি টাকায় ব্যাংকগুলোয় মূলধন জোগান দেয়া হয়। আর ব্যাংক তা খেয়ে ফেলে। ফারমার্স ব্যাংক তাদের মূলধন খেয়ে ফেলেছে। ব্যাংকটিকে মরে যেতে দেয়া উচিত। জনগণের টাকায় এর মূলধন জোগান দেয়ার কোনো মানে হয় না। আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পাশাপাশি কর, ভ্যাট ও শুল্ক আইন চাহিদা অনুযায়ী সংস্কারের প্রস্তাব দেন তিনি।

সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো একীভূত করতে আইন প্রণয়নের কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার কথা বলা হয়। কিন্তু এ-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। সংকটে ভোগা ব্যাংকগুলো যেন একীভূত হতে পারে, সেজন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগলে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার ভিত্তি তৈরিতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। কারিগরি ও বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনায় আরো বেশি সচেতন হতে হবে। দেশের ৩৮ শতাংশের বেশি মানুষ বেকার উল্লেখ করে এটিকে অর্থনীতির বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।

যেখানে-সেখানে ঋণ দেয়া, অব্যবস্থাপনাসহ যথাযথ নজরদারির অভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা বিরাজ করছে বলে জানান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, অনেক ব্যাংকই ঋণদানের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। ফলে মূলধন সংকট বাড়ছে। প্রতি বছর সংস্কার কার্যক্রমের নামে অকার্যকর কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। এটি মূলত দীর্ঘ সময়ের কাঠামোগত সমস্যার ফল, যা সমাধানে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

মেগা প্রকল্পগুলোয় দীর্ঘমেয়াদে ব্যয় বাড়ছে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে না পারায় ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমনি ভোগান্তিও সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়ন প্রস্তাবনা অনুযায়ী সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে না পারলে মেগা প্রকল্প থেকে ফল আসবে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় শেয়ারবাজার ফাঙ্কশন করছে না। শেয়ারবাজারে সংস্কার না এলে এ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হওয়ার যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আগে যেভাবে বিদেশ থেকে সাহায্য আসত, এখন আর সেভাবে আসছে না। দারিদ্র্য বিমোচনসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কিছু সাহায্য এলেও তা চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে। ফলে সরকারের এসডিজি বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারে। এজন্য চলতি বছরের বাজেট থেকে এসডিজি উন্নয়ন তহবিল গঠন করে সেখানে বরাদ্দ দিতে হবে।

ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কথা উল্লেখ করেন সাবেক অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে ব্যাপক হারে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়লেও সুফল আসবে না। বেপরোয়া ঋণ দেয়ার মাধ্যমে মূলধন ঘাটতিতে আছে দেশের ব্যাংকিং খাত। আবার পুঁজিবাজারে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আর্থিক খাতের সংস্কার ছাড়া উন্নয়নের সুফল মিলবে না।

বাজেটের আকার বাড়ানোর পরিবর্তে এর বাস্তবায়নে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক। তিনি বলেন, বছরের শুরু থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় শেষ দিকে এসে ব্যয় বেড়ে যায়। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে মুদ্রানীতি হওয়া উচিত।

শিক্ষার পরিধি বাড়লেও গুণগত মানে পরিবর্তন আসেনি বলে মন্তব্য করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। সরকারকে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এর আগে সূচনা বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আসছে ৭ জুন বাজেট উপস্থাপন করা হবে। আর ৩০ জুনের মধ্যেই বাজেট অধিবেশন শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এবারের বাজেটে পরিবহন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এসব খাতে বেশি বরাদ্দ থাকবে।

অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, অনেকে অভিযোগ করেন, নির্বাচনের বছরে আর্থিক খাতসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যান। তাদের ক্ষেত্রে সরকার নমনীয় নীতি নেয়। বিষয়টা ঠিক এমন নয়। কোনোভাবেই অপরাধীদের ছাড় দেয়া হবে না। আমাদের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের আগে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্টদের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় না। আবার প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেও আগে যাচাই-বাছাই করা হয়। সম্প্রতি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। এর মাধ্যমে আমদানি-রফতানি, নতুন ব্যবসা শুরুসহ ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের জটিলতার অবসান ঘটবে।