ভালো ব্যাংকের সঙ্গে ‘কুখ্যাত’ দুর্বল ব্যাংক মার্জার নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই: ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in The Business Standard on 24 March 2024

তুলনামূলক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে ‘কুখ্যাত’ দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ নিয়ে সাধারণ আমানতকারীসহ অনেক ব্যাংকের পরিচালকেরা উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পারছি, ভালো ব্যাংকগুলো চিন্তিত। কারণ ভালো ব্যাংক যারা আছে, তারা তো নিয়ম কানুন মেনে, কমপ্লায়েন্স মেনে, নানা ধরনের প্রতিকূলতা পার করে ভালো হয়েছে।’

শনিবার (২৩ মার্চ) ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রভাব’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

সাংবাদিক মুনির হায়দারের সঞ্চালনায় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান, অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ, গবেষক মাহমুদুল হাসান প্রমুখ।

ব্যাংক একীভূত করার একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে ১০টির মতো দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। তারই অংশ হিসেবে গত ১৮ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে।

ওয়েবিনারে ফাহমিদা খাতুন তার বক্তব্যে তারল্য সংকট, মূলধন সংকট, দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও খারাপ ঋণসহ ব্যাংকিং খাতে চলমান সংকট নিয়ে কথা বলেন। ‘এসব সংকটের একটা প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে রয়েছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে সংস্কার করার অনেক চাহিদা তৈরি হয়েছে।’

প্রকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোর মালিক কারা—এ প্রশ্ন তুলে ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রভাবশালীদের দুর্বল ব্যাংক প্রভাব খাটিয়ে মার্জার (একীভূতকরণ) তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে।

তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যেসব ব্যাংক তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে কিন্তু ক্ষমতার দিক থেকে অতটা প্রভাবশালী নয়, তাদেরকে টার্গেট করে মার্জারে জোর দিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, ‘২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক বাংলাদেশে শিল্প ঋণ সংস্থার সঙ্গে একীভূত হয়েছিল। একীভূত হয়ে বিডিবিএল হয়। নতুন সত্তা পাওয়ার পরেও এই ব্যাংকটা এখন খারাপ ঋণের ভারে তলিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক ছিলে রেড জোনে, এক্সিম ব্যাংক ছিল হলুদ জোনে। দুটি খারাপ ব্যাংক একীভূত হয়ে ভালো ব্যাংকি কীভাবে হবে। সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে।’

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে দুর্বল ব্যাংকের মন্দ অ্যাসেটগুলো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। যদিও অ্যাসেট ম্যানেজন্ট কোম্পানির গাইডলাইন তৈরি করতে ১৮ মাস লাগবে। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গাইডলাইন না করেই মার্জারের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে—এটা কি ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা নাকি অন্য উদ্দেশ্য?’

‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনায় ৬ দুর্বলতা’

ওয়েবিনারে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনায় ছয়টি দুর্বলতা চিহ্নিত করেন উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান। একইসঙ্গে এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণের দায় চূড়ান্তভাাবে করদাতাদের ওপরে চাপানো হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ অর্থনীতিবিদ।

জিয়া হাসান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত ভালো। তবে এক্ষেত্রে উচিট ছিল দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা। একইভাবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংক একীভূত করা।

‘এখন দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা হলে সেটার (ভালো ব্যাংক) অবস্থাও খারাপ হবার সম্ভাবনা থাকে। খারাপ ব্যাংকের অনেক দায় রয়েছে,’ বলেন তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক একীভূতকরণের পরিকল্পনায় ছয়টি দুর্বলতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই।

জিয়া হাসান বলেন, ‘ব্যাংকের সংখ্যা কমানো কার্যকরী লক্ষ্য হতে পারে না, মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল কন্সোলিডেশান। দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণেরন দায় চূড়ান্তভাবে দরিদ্র জনগণের ওপরে চাপানো হতে পারে।’

এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। আবার একই ধরনের প্রডাক্ট পোর্টফোলিও এবং ভৌগোলিক ডিফারেন্সিয়েশন না থাকা ব্যাংকগুলো কোনো স্ট্র্যাটেজিক ভ্যালু নেই। কোনো ধরনের সিনার্জি তৈরি হবে না।’

অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্জারের পরিকল্পনায় মূল সমস্যায় হাত দেওয়া হয়নি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদের দায় কে নেবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইএমএফসহ সবাই বলছে, মন্দ ঋণ ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে। সরকার ক্ষমতায় এসেই বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছিল। ব্যাংকের বিপর্যয় একদিনেই আসেনি, দীর্ঘ সময় ধরে এসেছে।’

সাংবাদিক মুনির হায়দার বলেন, ‘মনে হচ্ছে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের মার্জারটা ছিল জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। এর ফল কী হবে? ডুবে যাওয়া ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংককে একীভূত করলে লাভটা কী হবে? কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।’