ভারতের ‘পুশ ফ্যাক্টর’ ও আমাদের সক্ষমতা – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in সমকাল on 28 July 2021

এ বছর কোরবানির ঈদে আমরা দেশীয় গরুর জয়জয়কার প্রত্যক্ষ করলাম। কোরবানির পশুর বাজারে ভারতীয় গরুর উপস্থিতি এ বছরও তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। এ বছর যে পশুগুলো বাজারে উঠেছিল, সেগুলো মূলত কোরবানি উপলক্ষেই পালন করা হয়েছে। মূলত বিগত তিন-চার বছরে বাংলাদেশে কোরবানির পশুর বাজার এক ধরনের বাণিজ্যিক বাজারে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় ভূমিকা রেখেছে। তবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে এক ধরনের ‘পুশ ফ্যাক্টর’। আমরা জানি, ২০১৭ সালের ২৬ মে ভারতীয় পরিবেশ অধিদপ্তর উন্মুক্ত স্থানে গরু বিক্রি ও মাংস ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছিল। এর ফলে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আমদানি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় এক ধরনের আপাত সংকটের আশঙ্কা ছিল। অনেকেই বলেছিলেন, ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে কোরবানির বাজারে পশুর সংকট হতে পারে এবং গরুর মাংসের স্বাভাবিক মূল্য বেড়ে যেতে পারে। সে সময় সিপিডির পক্ষ থেকে আমরা বলেছিলাম, গরু রপ্তানি বন্ধে ভারত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার ফলে বাংলাদেশে বড় সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের দেশীয় খামারে উৎপাদিত পশু কোরবানির বাজারের চাহিদা মেটাতে পারে; এমনকি সারাবছর প্রয়োজনীয় মাংসের চাহিদাও। সে ব্যাপারটিই ঘটেছে ২০১৭-পরবর্তী চার বছরে। আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে গরু মজুদ ছিল দুই কোটি ৩৯ লাখ। ২০২০ সালে এসে এই সংখ্যা দুই কোটি ৪৩ লাখে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত তিন বছরে গরুর মজুদ বেড়েছে চার লাখ ৭৬ হাজার। এই সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ। বিগত সময়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ হওয়ার পরে বাংলাদেশে খামারি পর্যায়ে গরু উৎপাদনে প্রায় তিন গুণ হারে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। ইতোপূর্বে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ ভারতীয় গরু আমদানি করা হতো। সেই ১৫ লাখ গরুর ঘাটতি কাটিয়ে আমাদের দেশে এখন প্রায় ২০ লাখ গরুর মজুদ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে পশুসম্পদের দিক থেকে যা খুবই ইতিবাচক।

গরুর উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের নীতি-সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয় গরু রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত আসার পর ত্বরিত খামারি পর্যায়ে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এমনকি গরু উৎপাদনে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রায় ৪২৮০ কোটি টাকার বিশেষায়িত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ প্রকল্প ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়নাধীন। সারাদেশে ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর বাইরে ১৬২ কোটি টাকার মহিষ উৎপাদন প্রকল্প এবং পশুর পুষ্টি মানোন্নয়ন প্রকল্প এ মুহূর্তে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই বিশেষ প্রকল্পগুলো সারাদেশে পশুসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সারাদেশে ছোট খামার গড়ে উঠছে। এসব খামারে ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের গরু পালন করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে মাংসের মূল্য কমিয়ে আনা গেলে প্রাণিজ আমিষ তথা মাংসের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি করা যেত। সেটা হচ্ছে না মাংসের উচ্চমূল্যের কারণে। ২০১৭ সালে ঢাকার বাজারে মাংস বিক্রি হতো ৪৫০ টাকা কেজি দরে। এখন ৬০০ টাকা। অর্থাৎ সরবরাহ বাড়লেও মূল্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

মাংসের উচ্চমূল্যের বড় কারণ গরুর পরিচর্যা ব্যয়। আমাদের দেশে গরুর পরিচর্যা ব্যয় অনেক বেশি। ভারতীয় গরুগুলো ভারতে পাওয়া যেত তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার রুপিতে। আর সেগুলো ঢাকার বাজারে বিক্রি হতো ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার রুপিতে। ভারতে পশুখাদ্য বেশ সহজলভ্য হওয়ায় সেখানে পরিচর্যা ব্যয় অনেক কম। কিন্তু আমাদের দেশে পশুখাদ্যের যথেষ্ট সংকট। প্রাকৃতিকভাবে পশুখাদ্য প্রাপ্তিরও ঘাটতি রয়েছে এবং আমদানিকৃত ও শিল্পোৎপাদিত প্রসেস ফুডের আমদানি ও উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ছে। আমাদের দেশে গরু পরিচর্যা ব্যয় যদি কমিয়ে আনা না যায় এবং মাংসের মূল্য সাধারণ মানুষের সক্ষমতার মধ্যে আনা না যায়, তাহলে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী পুষ্টিবঞ্চিত থাকবে। উচ্চ পরিচর্যা ব্যয়ের কারণে দেশের ভেতরে মাংসের বাজার সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। পরিচর্যা ব্যয় ও মাংসের মূল্য কমানো গেলে চাহিদা সারাবছর থাকবে এবং খামারিরাও সারাবছরের জন্য গরু পালন এবং বাজারে মাংস সরবরাহ করতে পারবে। এতে কোরবানির সময়ে অবিক্রীত পশু পরে ভালো দামে বিক্রির সুযোগ থাকবে। পরিচর্যা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমদানিকৃত পশুখাদ্যে শুল্ক্কহার কমানো বা সমন্বয় করার প্রয়োজন হলে সরকার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে; পশুসম্পদ অধিদপ্তর সেভাবে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দিতে পারে এবং বাজেটে সে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

সরকার ঘোষণা করেছিল, এ বছর কোরবানির জন্য এক কোটি ১০ লাখ পশু প্রস্তুত। কোরবানির পর পশুসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই এক কোটি ১০ লাখ পশুর মধ্যে ৯০ লাখের মতো পশু কোরবানি হয়েছে। অর্থাৎ কোরবানির জন্য পালন করা ২০ লাখ পশু অবিক্রীত থেকেছে, যা খামারি পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে কাজ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে দেশের ভেতরে কীভাবে সারাবছর চাহিদা বৃদ্ধি করা যায়, তা দেখতে হবে। কৃষক পর্যায়ে পরিচর্যা ব্যয় হ্রাস এবং সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিকভাবে পশু পালনে নজর দিতে হবে। কারণ অনেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রাখেন। তারা হয়তো কোরবানির সময় ধর্মীয় কারণে মাংস ভক্ষণে আগ্রহী হন, কিন্তু অন্য সময় স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় এ ধরনের মাংস ভক্ষণ করতে চান না।
স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশু পালন, পরিচর্যা ব্যয় কমানো এবং মাংসের মূল্য কমিয়ে দেশীয় বাজারে ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে মাংস রপ্তানি আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমরা যদি রপ্তানি বাজারে পরিচিতি আনতে পারি তাহলে দেশীয় উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং খামারিরাও উৎসাহী হবেন। আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে। আর সারাবছর মাংসের চাহিদা রয়েছে ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও। এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুপালন। অন্যথায় আমদানিকারকরা কিনতে চাইবে না। সুতরাং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পশু পরিচর্যা কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসতে পারেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এতে পশুসম্পদ অধিদপ্তর সহযোগিতা করতে পারে।

মাংস রপ্তানি কাঠামো তৈরির পাশাপাশি সরকারকে জীবিত পশু রপ্তানির কাঠামোও চিন্তা করা দরকার। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জীবিত প্রাণীরও বাজার রয়েছে। এটা করা গেলে বছরজুড়েই আমরা পশুসম্পদ রপ্তানি করতে পারব। পশুসম্পদ খাত আগামী দিনে আমাদের দেশে প্রাণিজ আমিষের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে এবং এ থেকে নতুন আরেকটি বড় আর্থিক খাত গড়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে দরকার দেশীয় বাজারে মাংসের চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক রাখা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে খামারি পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা অব্যাহত রাখা দরকার।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)