মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার দারিদ্রসীমায় চলে যাবে – গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in সময়ের আলো on 21 May 2022

মধ্যবিত্তের চাপা কষ্ট

জালাল উদ্দিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বেতন ৪০ হাজার টাকা। অনেক হিসাব-নিকাশ করে চলেও তার পাঁচজনের সংসারে মাস পার করতে খরচ হয় ৫০-৫৫ হাজার টাকা। বাড়তি আয়ের সুযোগ না থাকায় প্রতি মাসেই ধার করে চলতে হচ্ছে তাকে। তিনি বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনরা আর কতই বা ধার দেবেন। সবারই তো একই অবস্থা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আত্মীয়-স্বজনরা কেউ আমাকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যান। এখন কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। আত্মসম্মানের কথা ভেবে ছোটখাটো কাজও করতে পারছি না। কষ্টের বিষয়টি না পারছি সইতে, না পারছি কারও কাছে কইতে।’ জামাল উদ্দিনের মতো প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবার ও সীমিত আয়ের মানুষের একই চাপা কষ্ট।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে সরু চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ৩০ টাকার প্রতি কেজি আটা ৪৫ টাকা এবং ৩৫ টাকার ময়দার দাম হয়েছে ৬৫ টাকা। এ ছাড়া ১১৮ টাকার খোলা সয়াবিন হয়েছে ১৯০ টাকা; বোতলজাত সয়াবিন ১৩৫ টাকা থেকে হয়েছে ২০০ টাকা। আবার ৫৮০ টাকার গরুর মাংস হয়েছে ৭০০ টাকা; ২২০ টাকার মুরগি হয়েছে ৩২০ টাকা; ৩০ টাকার এক হালি ডিমের দাম হয়েছে ৪২ টাকা। এভাবে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দামই বেড়েছে অস্বাভাবিক। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপণ্যেরে মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের ভেতর এখন চাপা কষ্ট বিরাজ করছে।

সেই চাপা কষ্ট স্পষ্ট হয় চাকরিজীবী জামাল উদ্দিনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, দুই বছর আগেও আমার মাসের বাজার খরচ লাগত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। সব কিছু দাম বাড়ায় এখন সেটি ২০ হাজারেও কুলাতে পারছি না। এর বাইরে দুই বছরে আমার ঘর ভাড়া বেড়েছে ৪ হাজার টাকা, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলও এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, যাতায়াত ভাড়া সবকিছুই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অথচ গত দুই বছরে আমার বেতন এক টাকাও বাড়েনি। উল্টো গত বছর করোনার কারণে বেতন ৮ হাজার টাকা কমিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। যদিও এখন আবার পুরো বেতন দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এতে তো আমি সংসার চালাতে পারছি না। খুব কষ্ট লাগে যখন আমার সন্তানরা খেলনা বা অন্য কোনো কিছু কেনার আবদার করে, কিন্তু কিনে দিতে পারি না। বিশেষ করে আমার তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলের খেলনার প্রতি খুব ঝোঁক। তাকে নিয়ে রাস্তায় বের হলেই সে খেলনা কিনে দেওয়ার বায়না ধরে। আগে আমি কখনও না করিনি। এখন তাকে খেলা না কিনে দিয়ে চকলেট দিয়ে বা অন্যভাবে বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে আসছি। ছেলের আবদার মেটাতে না পারা বাবা হিসেবে আমাকে খুব কষ্ট দেয়, চোখে পানি চলে আসে।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও একসঙ্গে সব ধরনের খাদ্যপণ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়তে দেখা যায়নি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দফায় দফায় বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, গাড়িভাড়া, বাড়িভাড়া। এক কথায় জীবন ধারণের জন্য যা দরকার তার সব অনুষঙ্গেরই মূল্য বেড়েছে। এতে একমাত্র ধনিক শ্রেণির মানুষ ছাড়া দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কষ্ট বেড়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা অসহায় মানুষ হয়তো বা বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কোনোমতে চলতে পারছেন; কিন্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো পড়েছে বিপাকে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘মধ্যবিত্তের আত্মসম্মান বোধ বেশি। তারা না খেয়ে থাকবে, তবু কারও কাছে হাত পাততে পারে না। এই কঠিন সময়ে যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল, সঞ্চয় বলতে কিছু নেই- তাদের দুর্দশাটা বেশি। প্রতিদিন যেভাবে পণ্য মূল্য ও সেবা মূল্য বাড়ছে সে অনুযায়ী তো আয় বাড়ছে না। শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো খাওয়া কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে এসব পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এভাবে চলতে থাকলে মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার তালিকায় চলে যাবে।’

দেশে মধ্যবিত্ত থেকে মানুষ যে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ মিলেছে গত দুটি বছর করোনাকালে। গত বছরের নভেম্বরে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ যে জরিপে এমন চিত্র ফুটে ওঠে। ‘জীবিকা, খাপ খাইয়ে নেওয়া ও উত্তরণে কোভিড-১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক ওই জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। গত বছরের মার্চে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ গত নভেম্বরে এসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এই নতুন দরিদ্র হওয়া মানুষগুলোই নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর সময়ের আলোকে বলেন, ‘নতুন দরিদ্র হওয়া এসব মানুষের অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। কারণ তাদের নাম সরকারি সহায়তার তালিকায় নেই। সরকারকে এসব নতুন দরিদ্র মানুষের কথা ভাবতে হবে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ে শহুরে মানুষ। দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচলিত প্রচেষ্টায় বা সামাজিক সুরক্ষার চলমান ধারায় এ দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘সামনে নতুন বাজেট আসছে। এ বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার দ্রব্যমূল্য কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেদিকে। বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে তিন লাখ টাকার স্থলে সাড়ে ৩ লাখ করা যেতে পারে। এতে করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিছুটা সুবিধা পাবে।’