মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা পর্যাপ্ত নয় – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in কালের কন্ঠ on 10 June 2022

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট একটি ব্যতিক্রমধর্মী সময়ে দেওয়া হলো, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটি চাপ আছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপরে এর একটা প্রভাব আছে। আবার আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিনিয়োগকে চাঙ্গা করার একটা তাগিদ এর মধ্যে আছে। মূল্যস্ফীতির একটা বড় চাপ আছে।

তবে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজন অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেওয়া হয়নি। যে ধরনের শুল্ক কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করার বড় পদক্ষেপ হলো আয়বর্ধক কর্মসৃজন পরিবেশ। এই আয়বর্ধক কর্মসৃজন নির্ভর করবে বাজেট কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার ওপর।

মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে দরকার ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কমানো। দ্বিতীয়ত, বাজার ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করে, দক্ষতা বাড়িয়ে আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের যে ব্যত্যয় আছে সেগুলো মোকাবেলা করা। কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা দেখিনি। মূল্যস্ফীতির নিরিখে সামাজিক সুরক্ষা খাত নিয়ে বড়ভাবে চিন্তা করা দরকার। এই খাতে বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু যতটা প্রয়োজন ছিল দেওয়া হয়নি।

বাজেটে আমরা আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পগুলোকে যেসব সুরক্ষা দিলাম, সেগুলো যাতে ভালোভাবে কাজ করতে পারে। তাদের জন্য যাতে ঋণের লভ্যতা থেকে শুরু করে ব্যবসা পরিবেশ ভালো থাকে। এগুলো করতে পারলে তখন আমাদের আয় বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা মোকাবেলা করতে পারব।

তবে খেয়াল রাখতে হবে, বাজেটে মূল্যস্ফীতির মোকাবেলা করা একদিকে দুরূহ কাজ। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, অন্যদিকে সরকারকে রেভিনিউ কালেকশন করতে হবে। সরকারকে সাবসিডি দেওয়াও বিবেচনা করতে হবে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে কিভাবে আয়বর্ধন কর্মসৃজন সৃষ্টি করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা করা যাবে, সেদিকে বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। বিনিয়োগ পরিবেশকে উন্নত করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের কিছু আইনের সংস্কার করতে হবে।

তবে এবারের বাজেট এমন কোনো উচ্চাভিলাষী বাজেট নয় যে বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ এনবিআরের রাজস্ব আহরণ যতটুুকু বৃদ্ধি করা হয়েছে তা খুব বেশি নয়। বাজেটে আমাদের আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্পকে কিছু সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। যার ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সুবিধা পাবেন। এটা ঠিক আছে। এই বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে যে বাড়তি লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, সেটাও চ্যালেঞ্জিং মনে হয়নি। তবে সরকারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

মূল্যস্ফীতির হার কমাতে গেলে এবারের বাজেটের চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আবার ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের কারণে এখানে নতুন আরেকটি উপাদান যোগ হচ্ছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতির একটা প্রভাব রয়েছে, যেটা বাজেটের মাধ্যমে কিছুটা অ্যাড্রেস করা হয়েছে, তবে তা পুরোপুরি নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থাকা শুল্ক কিছুটা হ্রাস করা, ভর্তুকি আগের মতো বজায় রাখা এবং বাজার ব্যবস্থাপনার কথা বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, মনিটর করা—এসব করার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সে রকম ঘোষণা বাজেটের রোড ম্যাপে নেই।

পাশাপাশি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার বিভিন্ন ধরনের যেসব চাপের মধ্যে আছে, তাদের কিছুটা সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বাজেটে। সরাসরি খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে আরো বেশি মানুষের এটা পাওয়া উচিত।

সাধারণ মানুষের দিক থেকে বাজেট বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে মানুষের কর্মসংস্থানের যে প্রয়োজনীতা তা বাড়ানোর তেমন কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বিশেষ করে করোনাকালে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের ৯০ শতাংশ ইন্টারনেটের সুযোগ পায়নি। যারা গ্রামে আছে, তাদের শিক্ষায় একটা ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পূরণের জন্য কী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেটা পরে আমাদের দেখতে হবে। বাজেট পেশের ক্ষেত্রে ২০১৫-১৬ সাল থেকে চাইল্ড বাজেট আলাদাভাবে দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা সেটা দেখিনি।