মেগা প্রকল্পের পরিস্থিতি ও প্রবণতা – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in সমকাল on 12 October 2023

অর্থনৈতিক মহামন্দা ১৯৩০ সালের পর থেকে মেগা প্রকল্পগুলো বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার জন্য জনপ্রিয় একটি নীতি-হাতিয়ার বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে আসছে। বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমপক্ষে ৭ শতাংশ নিশ্চিত করার জন্য ‘এসডিজি ফ্রেমওয়ার্ক’ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রায় ৫৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হবে।

এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (প্রায় ৩৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে মেগা প্রকল্পের বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো, যে দেশগুলো বাহ্যিক অর্থের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, সেগুলোর ওপর মেগা প্রকল্পগুলো ঋণের বোঝা বাড়ানোর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বড় প্রকল্পের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ভবিষ্যতে নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বড় ও মেগা প্রকল্পগুলো সময়মতো ও দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়ন করা না গেলে বিদেশি দায়দেনা পরিশোধে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের সময়ও এগিয়ে আসছে।

২০২৪ সাল থেকে এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। ২০২৬ সাল নাগাদ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। তাই ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই পরিকল্পনা দরকার।

বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হচ্ছে বৈদেশিক ঋণে। দেনার দাবিদার হিসেবে প্রথম সারিতে রয়েছে রাশিয়া। এর পর জাপান, চীনসহ অন্যান্য দেশ। ২০০৬ সালে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে যে ‘রূপকল্প-২০২১’ তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। প্রায়ই বলা হয়, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে বিনিয়োগ করা হয় তার ফলে সামাজিক খাতে যেটুকু উন্নয়ন হওয়ার কথা, সে ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও জাপানকেই বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধি করা জরুরি। এ ছাড়া এসব প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দায়দেনার পরিস্থিতি জটিল হওয়া এবং বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারগুলোও দৃশ্যমান। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশে যে আর্থিক বিপর্যয় পরিলক্ষিত হয়েছে, শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, সেসব দেশও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পথেই হেঁটেছে। সে জন্য বাংলাদেশেও এই আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। দেশের ২০টি বড় প্রকল্প বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব প্রকল্পের তালিকার অন্যতম হলো পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রভৃতি। এসব প্রকল্পে প্রায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৫ কোটি বা ৭০ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, যার প্রায় ৬২ শতাংশ বিদেশি ঋণ।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রচেষ্টার তাত্ত্বিক ও নীতিগত ভিত্তি

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূল অবকাঠামো (আয় উৎপাদনকারী) ভিত্তিক মেগা প্রকল্পগুলো বেছে নেওয়ার প্রবণতা বেশি মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রোজেন্সটাইন রোডেন সৰ্বপ্ৰথম ‘বিগ পুশ থিওরি’ সামনে নিয়ে আসেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যদি স্বল্পোন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশকে উন্নতির দিকে নিতে হয়, তাহলে প্রান্তিকভাবে অল্প অল্প করে বিনিয়োগ বাড়িয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন খাতের মধ্যে বিনিয়োগ করে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনা যায় না। তিনিই প্রথম তাত্ত্বিকভাবে স্থাপন করার চেষ্টা করেন যে, একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ যদি একসঙ্গে খাতের ভেতরে না আসে, তাহলে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন স্বল্পোন্নত দেশে সম্ভব নয়। তারা যে নিম্নমাত্রার ভারসাম্যের ভেতরে আটকে যায়, সেটা থেকে আর বের হতে পারে না। তিনটি চরিত্র খুব পরিষ্কারভাবে এটার ভেতরে আসে– এটা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হিসেবে আসে এবং মূলত রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে হয়, এটা ভৌত অবকাঠামো খাতে বেশি হয় এবং তৃতীয়ত, যেহেতু দেশের ভেতরে সঞ্চয় ও আয় কম, সেহেতু বৈদেশিক উন্নয়ন অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। গবেষণায় দেখা যায়, অবকাঠামো ব্যয়ের আর্থিক গুণক সাধারণ সরকারি ব্যয় গুণকের চেয়ে অনেক বেশি। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অবকাঠামোগত ব্যয় জিডিপিতে অন্যান্য ধরনের ব্যয়ের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অবকাঠামোভিত্তিক উন্নয়নের পেছনে প্রধান রাজনৈতিক যুক্তি হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বলা যায়, ২০০৯ সাল থেকে বড় প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের জাতীয় ঐকমত্য আছে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখা যায় বলে রাজনীতিবিদরা এতে আগ্রহ দেখান।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা : সাফল্য এবং বিপর্যয়

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় আনলে দেখা যায়, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্যের চেয়ে বিপর্যয়ের পরিসংখ্যান বেশি। এর অন্যতম উদাহরণ সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, কেনিয়া ও নাইজেরিয়ার প্রকল্প। আবার বিপর্যয়ের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চাদ, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার প্রকল্পগুলোর কথা। তাই বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলোকে বিবেচনায় রাখতে হবে। এর পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর অর্থনৈতিক তাৎপর্য কী, তাত্ত্বিক দিকটি কী, রাজনৈতিক আগ্রহ কেন আছে– এই ব্যপারগুলোকেও বিবেচনায় রাখা জরুরি তার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বাংলাদেশকে খুব সাবধানতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বড় ধরনের ধাক্কাগুলোকে মোকাবিলায় মনোযোগী হওয়া উচিত।

২০ মেগা প্রকল্পের সামষ্টিক বিশ্লেষণ

বিশটি মেগা প্রকল্পে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হচ্ছে ৭০ বিলিয়ন ডলার, যার দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশি ঋণ। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগ ভৌত অবকাঠামো সম্পর্কিত। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫০ শতাংশ। বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ শতাংশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ১২ শতাংশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রকল্পগুলোর গড় আয়তন ও ব্যয় অনেক বড় এবং বিদেশি অর্থনির্ভর। গত ২০১০ সাল থেকে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি প্ৰকল্প এসেছে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে। ২০টি প্রকল্পের মধ্যে ১৩টি এসেছে এই সময়। তবে দুই-তিনটি প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো বাস্তবায়নের অবস্থা ভালো নয়। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর যেসব প্রকল্প এসেছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন নগণ্য বা সন্তোষজনক নয় ৷

২০ মেগা প্রকল্পের প্রবণতা বিশ্লেষণ

আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে যেভাবে কাজ এগোচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আরও সময় নেবে। ওই ২০টি প্রকল্প ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি দশকে সবক’টি শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নে এক ধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। রাজস্ব আয় প্রত্যাশিতভাবে হচ্ছে না। ঘাটতি আছে প্রকল্প বাস্তবায়নে।

মেগা প্রকল্পগুলোর সংশোধনের একটি প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে। ২০টির মধ্যে ৭টি প্রকল্পই বিভিন্ন সময় সংশোধিত হয়েছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তিও রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় বলে, যদি মানসম্মত সমীক্ষা না থাকে, সমন্বয়ের অভাব থাকে, বাস্তবায়নের ঘাটতি থাকে, কাজ শেষ হতে সময় বেশি লাগে, দুর্নীতি হয়, সামষ্টিক অর্থনীতি দুর্বল থাকে, তাহলে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সুফল আসে না। বহু দেশে অনেক মেগা প্রকল্প বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সুতরাং বাংলাদেশে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

২০ মেগা প্রকল্পের অর্থায়ন এবং সরকারি আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ বাংলাদেশের ২০টি মেগা প্রকল্পের বৈদেশিক অর্থায়ন সাশ্রয়ীভাবে হয়েছে। এটা বড় সন্তোষের জায়গা। এসব প্রকল্পে ৪৫টি ঋণ প্যাকেজের মধ্যে পাঁচটি অনুদান। ৩৩টি সাশ্রয়ী ঋণ প্যাকেজ, আধাসাশ্রয়ী দুটি ও বাণিজ্যিকভাবে নিতে হয়েছে পাঁচটি ঋণ প্যাকেজ, যা চীন থেকে এসেছে।

তবে যতই বলা হোক, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা এক নয় । কিন্তু এটি তো ঠিক, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার পর বাংলাদেশের বাজেটে ঋণ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ‘বিদেশি ঋণ’ ঝুঁকিসীমার নিচে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আমাদের শ্রীলঙ্কার মতো পরিণতির শিকার হতে হবে না, সাধারণ মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখতে এমন অনেক কথাই বলতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শ্রীলঙ্কার মতো পরিণতি বিবেচনায় রেখে ঝুঁকি এড়াতে আমাদের বিদেশি ঋণে ঝোঁক কমাতেই হবে। দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি যেন ঊর্ধ্বগামী থাকে, অর্থনীতি যেন সুসংহত হয়, সেদিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। ঋণনির্ভরতা কমাতে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে। বৈদেশিক ঋণ কাটছাঁট করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে সবসময় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়াও ঠিক নয়। এতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। বৈদেশিক ঋণের রেয়াতকালের (গ্রেস পিরিয়ড) দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে চীন, তার পর জাপান ও রাশিয়া। তাই ঋণ পরিশোধের চাপটা আগে চীন থেকেই আসবে।

আশঙ্কার কথা, বৈদেশিক দায়দেনা জিডিপির ১৭ শতাংশের নিচে ও অভ্যন্তরীণ দায়দেনা ১৭ শতাংশের ওপরে। লক্ষণীয় হলো, এটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ২০১৮ সালের পর দায়দেনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় অংশ ৩৬.৬ শতাংশ যাবে রাশিয়ার কাছে, এর পর জাপানে যাবে ৩৫ শতাংশ এবং চীনের কাছে প্রায় ২১ শতাংশ। যদিও পরিমাণের হিসেবে চীন তৃতীয় হলেও দায়দেনা পরিশোধের সময়সূচি অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে চীনকে। বিরাট ধাক্কা সামলাতে কর আহরণ বাড়াতে হবে। কারণ কর-জিডিপির অনুপাত এখনও ১০ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনও ঝুঁকিসীমার নিচে রয়েছে। ভবিষ্যতে ঋণের এ অবস্থান ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে কমানো যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। ঝুঁকিসীমার নিচে থাকলেও আমাদের বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, ইউরোপকেন্দ্রিক ঋণ জটিলতা ও পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নমনীয় ঋণের উৎসও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এসব প্রতিকূলতায় সংশ্লিষ্টদের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। ইআরডির তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ বাংলাদেশ যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করেছে। এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিস্তি পুনঃতপশিলীকরণের জন্য বাংলাদেশের কখনও আবেদন করার প্রয়োজন হয়নি। তবুও কঠিন শর্তের ঋণের ঝুঁকি প্রশমনে ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিসের সঙ্গে সংগতি রেখে ঋণের নমনীয়তা পরীক্ষা ও অনুমোদনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এক খাতেই ৪০ বিলিয়ন ডলারের ১১ প্রকল্প

মেগা প্রকল্পের আওতায় যেসব খাতে খরচ পরিবাহিত হচ্ছে, এর মধ্যে ৪০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। এই খাতে একটি মন্ত্রণালয়ের ১১টি প্রকল্পে পাঁচ থেকে ছয় বছরে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মেগা প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়নি। যদি সুষমভাবে প্রকল্প বণ্টন করা হতো, তাহলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো প্রয়োজনীয় খাতে আরও বেশি বড় প্রকল্প নেওয়া যেত। মেগা প্রকল্প যতই যৌক্তিক হোক না কেন, তার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতকে উপেক্ষা করা চলবে না। অথচ বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির আনুপাতিক হিসাব অনুযায়ী কমে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের একটি ভূমিকা থাকা দরকার ছিল।

আইএমএফের অর্থ নেওয়ার পক্ষে মত

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ গ্রহণ ইতিবাচক। যে কোনো অঙ্কেরই হোক না কেন, আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এটা মধ্য মেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা এক ধরনের আস্থা পাবেন। বাংলাদেশকে এক ধরনের পরিবীক্ষণ ও নজরদারিতে রাখছে আইএমএফ। সরকার আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে, এটাই শুভকর ছিল। আইএমএফের কাছে শুধু টাকার জন্য যে কোনো দেশ যায় না। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা বলে, তারা যখন আইএমএফের কাছে গেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সাশ্রয়ী হতে তিন পরামর্শ

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থ সাশ্রয়ে তিনটি পরামর্শ হলো–

১. যেসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি, সেসব প্রকল্প জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ না হলে সাময়িকভাবে স্থগিত করা;

২. প্রকল্পের কেনাকাটা যেন অতিমূল্যায়িত না হয়;

৩. বিদেশি দায়দেনা পরিশোধের সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ করা।

লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)