যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিত ও আমাদের করণীয়

বণিক বার্তা: 

স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাণিজ্য সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্কিম চালু করে ১৯৭৬ সালে। উদ্দেশ্য ছিল, এ সহায়তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা পেয়ে থাকে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো অতিরিক্ত আরো এক হাজার ৫০০টি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য স্কিমটির বিশেষত্ব হলো— তারা এর আওতায় শূন্য শুল্ক সুবিধায় পণ্য রফতানি করতে পারে। বাংলাদেশও তার কিছু পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম থেকেই জিএসপি স্কিমের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, যে পাঁচ হাজার পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা যায় তার মধ্যে অধিকাংশ তৈরি পোশাক সামগ্রী নেই। ফলে বাংলাদেশের মতো যেসব দেশের মূল রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক, তাদের জন্য এ সুযোগ সদ্ব্যবহারের সুযোগ সীমিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের মোট রফতানির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪৯০ কোটি ডলার, যার মধ্যে প্রায় ৯৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। বাস্তবে রফতানিকৃত বাংলাদেশী পণ্যগুলোর কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পেত না। তৈরি পোশাকের বাইরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত চিংড়ি, সবজি এবং পাট ও পাটজাতসহ কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত মোট পণ্যের কেবল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পণ্যে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পেত। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে গিয়ে তাদের সরকারকে প্রায় ৪ কোটি ডলারের মতো শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের জন্য সীমিত ছিল। ফলে অনেকে মনে করতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্কিম বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তবে এত কিছুর পরও এর ভিন্ন গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত. আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে, এ মুহূর্তে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্যের বাইরে আর কিছু তেমন একটা রফতানি হচ্ছে না, তবে ভবিষ্যতে রফতানি বৈচিত্র্যকরণের সঙ্গে সঙ্গে এ শূন্য শুল্ক সুবিধা নিঃসন্দেহে আমাদের কাজে লাগবে।
দ্বিতীয়ত. জিএসপি স্কিম একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্কিম একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নবায়ন করা হয়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপির যে স্কিম নবায়ন করেছে, তা ২০১৩-এর জুনে শেষ হবে। সাধারণত এ ধরনের মেয়াদকাল উত্তীর্ণ হওয়ার নিকটবর্তী সময়ে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ ও পণ্যগুলোর একটি পর্যালোচনা করা হয়। এ প্রক্রিয়ার কোনো একটি পর্যায়ে তৈরি পোশাকও এ স্কিমের আওতায় আসতে পারে বা আওতাধীন তৈরি পোশাকপণ্যের সংখ্যা বাড়তে পারে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশের ক্ষতি হবে বৈকি।
তৃতীয়ত. এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এক্ষেত্রে প্রচলিত জিএসপি স্কিম থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ায় বিশ্বে একটি ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত যেসব দেশ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য আমদানি করে, তাদের কাছেও একটি নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাবে এর মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে প্রদত্ত জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ায় তারাও প্রভাবিত হবেন। বাংলাদেশী এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এর দ্বারা প্রভাবিত হবেন।
চতুর্থত. সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিকের প্রাণহানির পর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বহাল রাখা নিয়ে বিতর্ক হয়। তারা জানায়, আগামী ছয় মাস তৈরি পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইউরোপের জিএসপি বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সেখানে আমাদের তৈরি পোশাকসহ সব পণ্য শূন্য শুল্ক সুবিধা পায়। উত্স নীতি (রুলস অব অরিজিন) সহজীকরণ হওয়ার পর বাংলাদেশী তৈরি পোশাক, বিশেষত ওভেন পোশাক রফতানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। গত দুই বছরে রফতানি আয় প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ইউরোপিয়ান দেশগুলোয় ওভেন পোশাকের বাজার সম্প্রসারণের। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি বাতিল করায় ইউরোপেও তার প্রভাব পড়বে কিনা, তাই এখন দেখার বিষয়।
পঞ্চমত. যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করায় সেখানকার ভোক্তারাও এ দেশের পণ্য কেনা ও ব্যবহারে নিরুত্সাহিত হবেন বলে ধারণা। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা থেকে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধা পাওয়া না গেলেও পরোক্ষভাবে তা আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আমরা জানি, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম পরিবেশ, শ্রমিকদের মজুরিসহ সম্মিলিতভাবে তাদের অধিকার বিষয়ে (কালেকটিভ বারগেইন রাইটস) দরকষাকষির ক্ষমতা প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে অভিযোগ করে। তারপর থেকে পর্যাবৃত্তিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে কিছু শর্তসাপেক্ষে তারা বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধার সময়সীমা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে এদেশের শ্রম পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল চলতি বছরের মার্চে। জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিনিধি এ শুনানির আয়োজন করে। বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। ট্রেড ইউনিয়ন, বাণিজ্য, কৃষিসহ অন্যান্য বিষয় সম্পর্কিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমিও সেই প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য ছিলাম। শুনানিতে প্রথমে এএফএল-সিআইও তাদের বক্তব্য দেয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তাদের উত্তর দেয়। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা লিখিতভাবে বাংলাদেশকে আরো কিছু প্রশ্ন জানায়, যেগুলোর উত্তরও বাংলাদেশ দিয়েছে ২৪ এপ্রিল। ঘটনাক্রমে সেদিনই সাভারের রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। আশা ছিল, তাদের প্রশ্নের যেসব উত্তর আমরা দিয়েছি এবং পরে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বা করবে বলে সরকার জানিয়েছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট হবে। বলা হয়েছিল, ২০০৬ সালের শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার প্রদানসহ নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত তা সংসদে পাসের ব্যবস্থা করা হবে। এক্ষেত্রে অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে। এরই মধ্যে খসড়া শ্রম আইনটি মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন লাভ করেছে। জাতীয় সংসদের চলতি বা আগামী অধিবেশনে এটি পাস হবে বলে আশা করা যায়। এ আইনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, কর্মপরিবেশ, কারখানা পরিদর্শন ইউনিটগুলোকে শক্তিশালী করা প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ আছে।
এএফএল-সিআইওর আরো অভিযোগ ছিল, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও এ দাবি উত্থাপনের কারণে কিছু শ্রমিককে হেনস্তা করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এরকম যেন না হয় তা দেখা হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। ২৭টি ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন হয়েছে এরই মধ্যে। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো দূরীকরণের প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করছে সরকার। বাংলাদেশ আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হবে। সেটিও করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন এবং এর কারণে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেসব প্রত্যাহার করে নেয়ার আবেদন জানিয়েছিল তারা। সেটিও রক্ষা করছে বাংলাদেশ। সর্বোপরি এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আরো কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা আশা করছিলাম, নিদেনপক্ষে বাংলাদেশকে আবারো হয়তো ‘?ওয়াচলিস্টে’ রাখা হবে। অর্থাত্ ২০০৭ সালের পর থেকে যে প্রক্রিয়াটি চলে আসছিল, তেমন নীতিই গ্রহণ করা হবে এবার— জিএসপি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হবে এবং কী অগ্রগতি অর্জন করছে সেটি দেখা হবে।
কিন্তু রানা প্লাজা ধসের পর আবার সারা বিশ্বের নজর পড়েছে বাংলাদেশের প্রতি। তারা দেখেছে কীভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। ভবনটি ধসে পড়তে পারে বলে সতর্ক করা হলেও তা মানা হয়নি, কারখানা চালু রাখা হয়েছে। কোনো ধরনের নিরীক্ষা ছাড়া ভবন নির্মাণ ও শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল এতে। যদিও এর সঙ্গে জড়িত সাতজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, শ্রমিক সংগঠন, ভোক্তাগোষ্ঠী এমনকি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ঘটনার পর অনেক প্রশ্ন তুলছে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বহাল না রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়। সিদ্ধান্তটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিয়েছেন। কিন্তু ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) এ-সংক্রান্ত পরামর্শ বা সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতিকে। জিএসপি সুবিধা পাওয়ার শর্ত অর্থাত্ কোন কোন দেশ তা পেতে পারে, সেখানে স্পষ্টভাবে সাতটি বিষয়ের কথা বলা আছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ওই দেশ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিচ্ছে কিনা, শ্রমিক অধিকার পালন করা হচ্ছে কিনা, তারা নির্ভয়ে সংগঠন করতে পারছে কিনা, কালেকটিভ বারগেনিং করার ক্ষমতা আছে কিনা প্রভৃতি। বর্তমান অবস্থায় তিনটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এক. জিএসপি সুবিধা বহাল রাখা। দুই. এটিকে বাতিল করা। তিন. জিএসপি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানোর সঙ্গে সময়ে সময়ে অগ্রগতির মূল্যায়ন।
সার্বিক অবস্থা, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছিল, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বতিল করা হবে। রাষ্ট্রপতির ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের। সিনেটের পররাষ্ট্র-বিষয়ক চিফ রবার্ট মেনেনডেস বাংলাদেশের প্রতি কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে ছিলেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রবার্ট ব্লেইক বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। জিএসপি সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশে যাতে শ্রমিক অধিকার রক্ষিত হয়, তার পদক্ষেপ নেবেন তারা।
জিএসপি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হলো, শ্রমিকের কল্যাণে কোন দেশের সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা বিবেচনায় নেয়া। ব্যবসায়ীরা কী করছে, তা তাদের চিন্তায় তেমন একটা প্রাধান্য পায় না। এদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার অনেক ক্ষেত্রে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আবার অনেক দিকে সরকারের দুর্বলতা রয়ে গেছে। রানা প্লাজা ধসের মাধ্যমে দেখা গেল প্রশাসনের চোখের সামনে তদারকিবিহীন এমন একটি ভবন গড়ে উঠেছে। এর দায় শুধু মালিকের ওপর চাপালে হবে না, সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। বিল্ডিং কোড আছে, তদারকির ব্যবস্থা আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় যথাযথ দেখভাল করেনি। এসব দিক বিবেচনায় জিএসপি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। অর্থনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেলেও জিএসপি সুবিধা বাতিল করার বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর আগে প্রায় ১৩টি দেশের জিএসপি স্কিম বাতিল করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের জিএসপি সুবিধা বাতিল করায় নতুন করে আবার এর আওতায় আসা কষ্টকর হবে।
বর্তমান অবস্থা আমাদের জন্য একটি সুযোগও হতে পারে। এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি চিন্তাভাবনায় রেখে বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটি যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে জানানোর বিষয় রয়েছে, তেমনি পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে শক্তিশালী ভূমিকা রাখারও অবকাশ রয়েছে। এক্ষেত্রে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভূমিকা রাখতে পারে।
আমরা আশাবাদী হতে চাই। রানা প্লাজা ধস বেদনাদায়ক এক অধ্যায় হলেও অনেকে এটাকে সুযোগ হিসেবেও দেখছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, কর্মপরিবেশ, মজুরি প্রভৃতির মৌলিক পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থাগুলো আমাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছে। শ্রমিক অধিকার ও কর্মপরিবেশ উন্নত করতে তহবিল গঠনের উদ্যোগও তারা নিয়েছে। সরকারও একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। দেখাতে হবে— বাংলাদেশের সরকার প্রকৃত অর্থে পরিবর্তন চায় কিনা। সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা যদি বাস্তবায়ন করে, শুধু তখনই জিএসপি সুবিধা পুনরায় প্রদান করবে যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকে অভিযোগ করছেন, বাংলাদেশ এর আগেও এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু অগ্রগতি হয়নি। আরেকটি বড় বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাগোষ্ঠীও বলেছে, এবার কিছু একটা করতে হবে। সবটা মিলে ওবামা সরকারকে রাজনৈতিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক সম্ভাব্য ফলাফল, ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু প্রভৃতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্তটি জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা। আমাদের জন্য ভালো হতো, যদি জিএসপি স্কিমের মেয়াদ কিছুটা বাড়িয়ে বাংলাদেশকে সময় দেয়া হতো অবস্থা পরিবর্তনের।
বাংলাদেশকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে হবে দ্রুত। এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হবে, জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্যই যে শ্রমিকদের অধিকার, দক্ষতা, মজুরি বাড়াতে হবে, তা কিন্তু নয়। আমাদের নিজেদের স্বার্থে উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ, মজুরি বাড়ানো, শ্রমিকদের অধিকার প্রদান, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি, কালেকটিভ বারগেনিং পাওয়ার, জীবনযাত্রার মান প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে। এগুলো টেকসই শিল্পায়ন ও শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় নিজেদেরই করা উচিত। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের বৃহত্ একটি শিল্প। অর্থনীতিতে তারা বড় অবদান রাখছে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমেও। এর সঙ্গে আমাদের আমদানি সক্ষমতা, শ্রম নিয়োজন, শিল্পায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ প্রভৃতি মিলিয়ে খাতটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যারা অবদান রাখছেন, তাদের মৌলিক অধিকার আমাদের নিজেদের জন্যই নিশ্চিত করা উচিত।
রানা প্লাজা ধস নিশ্চিতভাবেই ‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ একটি বড় আঘাত পেয়েছে। এ দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা কার্যকর এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারি এবং এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কমপ্লায়েন্ট বলে পরিচিত পায়, তবে রফতানি ক্ষেত্রে আমাদের জন্য নতুন দ্বার খুলে যেতে পারে। বিশ্বে পোশাক রফতানিতে প্রথম স্থান চীনের। বিশ্বে মোট তৈরি পোশাক রফতানির ৩৩-৩৪ শতাংশ চীন থেকে হয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও তৈরি পোশাক রফতানির বিশ্ববাজারে আমাদের অংশ মাত্র ৬ শতাংশ। উভয় দেশের মধ্যে ব্যবধানটি অনেক বড়। আমরা দেখছি, ইউরোপের বাজারে চীনের পোশাক রফতানি কমে আসছে এবং সেখানে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বাড়ছে। পাশাপাশি ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়ার রফতানিও বাড়ছে। এক্ষেত্রে ‘চীন প্লাস ওয়ান’ নীতি বড় ভূমিকা রাখছে। পোশাক পণ্য বাজারে চীনের অংশীদারিত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ কিন্তু তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে। এটা করতে হলে কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলোকে আমলে নিতে হবে। কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করা গেলে বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসবে। কারণ বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেশ ভালো। বাংলাদেশের শ্রমিকরা দ্রুত শিখতে পারে। এটা কাজে লাগিয়ে সরকার, উদ্যোক্তা এবং ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানরা যেসব পদক্ষেপ নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে। উন্নয়ন সহযোগীরাও এক্ষেত্রে অংশীদার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এরই মধ্যে সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হলে উদ্ভূত সংকটকে পোশাকশিল্প খাত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হিসেবেও দেখতে পারি আমরা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের আরো বিকাশ ও উন্নয়নের একটা সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে বর্তমান সময়— এটি ভুললে চলবে না। মনে রাখতে হবে, জিএসপি সুবিধার বাইরে এ বিষয়গুলোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি