রংপুর অঞ্চলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি: সংলাপে বক্তারা

Download Presentation

দেশের উত্তরাঞ্চলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা এ অঞ্চলে উন্নয়নের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। এ দাবী উঠে এসেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর পক্ষ থেকে আয়োজিত জাতীয় উন্নয়নে অঙ্গীকার: শিক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান, জেন্ডার সমতা শীর্ষক আঞ্চলিক সংলাপে। দারিদ্রতা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, অবকাঠামো ইত্যাদি নানা দিক থেকে রংপুর অঞ্চল পিছিয়ে আছে। বেকারত্বের উচ্চ হার এই অঞ্চলের যুব সমাজকে হতাশাগ্রস্থ করে তুলেছে। অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিদের সময়মত না পাওয়া, নদী ভাঙ্গন, শ্রমিক ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, বন্দর অব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব, প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সুজন – সুশাসনের জন্য নাগরিক – এর সহযোগীতায় এবং জাতিসংঘ ডেমোক্রেসি ফাণ্ড (ইউএনডিইএফ)-এর সার্বিক সহযোগীতায় সিপিডি সংলাপটি ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে রংপুরে আয়োজন করে।

নির্বাচনের প্রাক্বালে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহারের মাধ্যমে তাদের উন্নয়নের অঙ্গীকার করে। ইশতেহারে বর্ণিত অঙ্গীকারসমূহ যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটিকে দল ও ভোটারদের মাঝে একটি লিখিত চুক্তি বলে ধরে নেওয়া যায়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে “সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ” শিরোনামে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ প্রকাশ করে। সংলাপে নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার সমূহ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়।

. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি সংলাপের সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দল্গুলো নির্বাচনী ইশতেহার সম্পর্কে জনগনের আগ্রহ বাড়ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই এখন নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো স্মরণ করে এবং এগুলো বাস্তবায়নের কথা বলে। কিন্তু আজকের আলোচনা থেকে আমরা জানতে চাই এই ইশতেহার তৈরিতে জনগনের সম্পৃক্ততা কতটুকু, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এই ব্যাপারে আপনাদের সাথে কতটুকু আলোচনা করেন, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিশ্রুতিগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে।

. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন–সুশাসনের জন্য নাগরিক সংলাপে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন এবং তিনি আশা করেন দেশে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পিছিয়ে পরা রংপুর অঞ্চলে এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উভয়েই ইশতেহার তৈরি এবং বাস্তবায়নে সোচ্চার হবেন।

সিপিডি’র সংলাপ ও যোগাযোগ বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জনাব অভ্র ভট্টাচার্য সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। উপস্থাপনায় তিনি বিভিন্ন সুচকে রংপুরের অঞ্চলের অবস্থা তুলে ধরেন। এছাড়াও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের শিক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান, জেন্ডার সমতা বিষয়ে বিভিন্ন অঙ্গীকার এবং অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, এই সংলাপের আগে বাংলাদেশের ৯০ টি স্থানে মুক্ত আলোচনা করা হয়, যেখানে প্রায় ৯১৮ জন উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থাপনায় রংপুর অঞ্চলের মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের ইশতেহার সম্পর্কে মতামত এবং পরামর্শও তুলে ধরা হয়।

এই সংলাপে রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা এবং রংপুর জেলার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নিয়ে অংশগ্রহণকারীরা তাদের সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে বলে।  রংপুরের জনাব আফতাব হোসেন মনে করেন নদী ভাঙ্গন, অতিমাত্রায় কৃষি নির্ভরশীলতা এবং কাজের অভাব এই অঞ্চলের দারিদ্রতার প্রধান কারণ। এর প্রতিকার হিসেবে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরন, কৃষকের ন্যায্য পাওনা আদায়ের কথা। গাইবান্ধার অঞ্জলি রানী দেবী কেন বালাসী ঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত সেতু তৈরি করার পরেও তা চলাচলের উপযোগী নয়া তিনি ব্যাপারে তদন্তের দাবী করেন এবং গাইবান্ধার সাওতাল পাড়ায় ইপিজেড অথবা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করে রংপুর অঞ্চলের ব্যবসা বানিজ্যের প্রসারের কথা বলেন। রংপুরের এক নারী প্রতিনিধি উত্তরবঙ্গের সাথে অন্যান্য বিভাগের সরাসরি রেল ব্যবস্থা, সরকারি স্কুল বৃদ্ধির দাবি করেছেন এবং মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন এই অঞ্চলে প্রতিশ্রুত আইটি পার্কটি কবে নাগাদ হবে। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার আমিরুল ইসলাম তিস্তার বাধ নির্মান, নদী ভাঙ্গন রোধ এবং কৃষি নির্ভর শিল্প নগরী গড়ে তোলার দাবি করেন। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংরাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব শফিউর রহমান, মনে করেন তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবন মান উন্নয়ন, আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে অতি দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। কুড়িগ্রামের খন্দকার খাইরুল আলম বলেন কুড়িগ্রামে সরকারের দেয়া বিভিন্ন ভাতা পেতে সরকারি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে হয়রানির শিকার হতে হয়। বদরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা (অবঃ) মেজর নাসিম বলেন কৃষকের পাওনা পাচ্ছে বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী গোষ্ঠী। পঞ্চগড়ের একেএম ফজলে নুর বলেন চা চাষীরা সুবিধা বঞ্চিত, এছাড়া চিনি কল বন্ধের কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তিনি পঞ্চগড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল স্থাপনের ক্ষুদ্র দাবি করেন। নীলফামারী জেলার সৈয়েদা রোকসানা সানু বলেন সৈয়দপুরে ইনলাইন কন্টেইনার ডিপো তৈরি করলে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। রংপুরের এক যুবক মনে করেন যথাযথ ফ্রিল্যান্স প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমানোর ক্ষমতা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবদুল্লা আল মাসুম বলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম সংকট, হল সুবিধা নেই এবং শহরের মেসগুলো বাসযোগ্য নয়। সাবেক কারমাইকেল কলেজের ভিপি মোঃ আলাউদ্দিন মিয়া দাবী করেন সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার এবং নারীর বেতন বৈষম্য দূর করতে বলেন। এছাড়াও লালমনিরহাটের এক নারী প্রতিনিধি বলেন নারীরা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেতে নানান ধরনের প্রশাসনিক জটিলতায় পরেন।

জনাব টিপু মুনশি, এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংলাপের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহারকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য বাস্তিবায়িত না হলেও বাস্তবায়নের সদিচ্ছা আছে। তিনি মনে করেন কাঁচামাল সরবরাহ এবং গ্যাসের অতিরিক্ত খরচ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা রংপুর অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে নারাজ। তিনি আশাবাদী যে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। তাছাড়া, উত্তরবঙ্গে অর্থকরী ফসল হিসেবে চা চাষের প্রসার আশার আলো দেখাচ্ছে।

জনাব মোস্তাফিজার রহমান, মাননীয় মেয়র, রংপুর সিটি কর্পোরেশন সংলাপের বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সরকারের সুশাসন এবং জাতীয় বাজেটের অসম বন্টনকে উত্তরবঙ্গের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থনীতি, শ্রমিকের দক্ষতা, প্রশাসনিক কাঠামো এবং অন্যান্য দিকে পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

সংলাপে সম্মানিত বক্তা হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু, সভাপতি, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বলেন,  ফুলছড়ি-বাহাদুরবাদ রেল ব্রিজ স্থাপন হলে ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে রংপুর অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হবে। নারী নেত্রী মোশফেকা রাজ্জাক উল্লেখ করেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত নির্বাচনী ইশতেহার সকল জনগনের কাছে পৌঁছে দেয়া যাতে করে জনগন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা কাকে ভোট দেবে। তিনি আরও বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নারীরা কোনো ব্যাংক থেকেই সুবিধা পাচ্ছেন না। সুজন–সুশাসনের জন্য নাগরিক, রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন, বলেন, দেশের দক্ষিণে অনেক মেগা প্রকল্প, কলকারখানা হলেও দেশের উত্তরে এখনও এসব দিক থেকে পিছিয়ে আছে। তিনি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন যাতে অবিলম্বে তাদের দুর্ভোগ কমাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। জনাব মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, হেড অব ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, আরডিআরএস বাংলাদেশ সংলাপে বলেন, নির্বাচনি ইশতেহার হতে হবে অন্তর্ভূক্তিমুলক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি জনাব মমতাজ উদ্দিন আহ্মেদ উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার ইশতেহার বাস্তবায়নে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সংলাপে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করছি।