রপ্তানিমুখী শিল্পের ইমেজ সৃষ্টি হয়নি: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in ভোরের কাগজ on 30 July 2021

চামড়া শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার ও রপ্তানিমুখী বাজারকে আলাদা করা। এর কারণে বৈশ্বিক পর্যায়ে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে এ পণ্যটির এখনো ইমেজ গড়ে উঠেনি বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাত অভ্যন্তরীণ পোশাক থেকে আলাদা করে এগিয়ে যেতে পেরেছে। চামড়া শিল্প সেই বিভাজন করতে পারেনি।

ড. মোয়াজ্জেম বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্প- এ দুটির ভোক্তা গ্রুপ আলাদা। কমপ্লায়েন্স রিকোয়ারমেন্ট আলাদা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ দুটো একসঙ্গে জট পাকিয়ে থাকার জন্য আলাদা আলাদাভাবে চামড়া খাতে যে জিনিসগুলো নিশ্চিত করা দরকার সেগুলো করা যাচ্ছে না। বিভাজন না করতে পারায় দীর্ঘদিন ধরে খেসারত দিতে হচ্ছে চামড়া শিল্পকে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া শিল্পকে ব্র্যান্ডের পণ্য হিসেবে সক্ষমতা অর্জন করতে হলে পরিবেশ মানদণ্ডে উত্তরণ ঘটাতে হবে। কিন্তু চামড়া শিল্পের সঙ্গে যারা যুক্ত, বিশেষ করে ট্যানারি মালিকরা কখনোই পরিবেশ মানদণ্ডকে গুরুত্ব দিতে চান না। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে- অভ্যন্তরীণ বাজারে পরিবেশ মানদণ্ড খুব একটা দরকার পড়ে না। তাই আন্তর্জাতিক বাজারকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে চান না। পরিবেশ মানদণ্ড উত্তোরণ করতে হলে আলাদা ব্যয়, আলাদা অবকাঠামো দরকার, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা দরকার। এগুলো না হওয়ায় আমাদের দেশের চামড়াজাত পণ্য বাইরের দেশে থার্ড পার্টি বায়িং হয়ে থাকে। আমাদের দেশে চামড়ায় তৈরি কোনো কোনো পণ্য তারা নিতে চান না।

এ গবেষক বলেন, আমাদের দেশেও আন্তর্জাতিক মানের চামড়া তৈরি হয়। কর্ণফুলীতে ইপিজেড আছে, সাভার ইপিজেড রয়েছে। সেখানেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরি করে। কিন্তু পরিবেশ মানদণ্ডের উত্তরণ ঘটাতে পারেনি বলে সেখানে কঠিনভাবে শর্ত রয়েছে যে বাংলাদেশি চামড়া ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে। ২০১৯ সালে ১১০ মিলিয়ন ডলারের চামড়া আমদানি করতে হয়েছে। যদিও দেশি চামড়ার গুণমান ভালো। কিন্তু পরিবেশ মানদণ্ডে উত্তরণ ঘটাতে না পারায় ভোক্তারা এগুলোর বিষয়ে কঠোর থাকেন এবং ব্র্যান্ড বায়াররা এ সমস্ত পণ্য নিতে চান না। এজন্য চামড়াকে আমরা রপ্তানিমুখী পণ্য হিসেবে এখনো বড় উত্তরণ ঘটাতে পারিনি।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শিল্প হিসেবে চামড়া খাত পিছিয়ে পড়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ট্যানারি মালিক চামড়ার শুধু প্রসেস করেন- রপ্তানি করেন না, তারাও শুধু রপ্তানির কথা মাথায় রেখে ট্যানারি অবকাঠামোকে পরিবেশ মানদণ্ডে উত্তরণ করতে উৎসাহী নয়। আবার এ চামড়াই রপ্তানির জন্য ব্যবহার করতে চান। ফলে আমাদের রপ্তানি মার খাচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়েই সাভারে চামড়া শিল্পনগরীর কাজ শুরু হয়েছিল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) চামড়াজাত দ্রব্য পরিবেশসম্মত উপায়ে উৎপাদিত হয় কিনা এ ব্যাপারে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই নিজস্ব প্রযুক্তিতে, নিজস্ব ধ্যান-ধারণা দিয়ে এখানে একটা ইটিপি করা হয়েছে। যেটা আসলেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কোনো ইটিপি হয়নি। সুতরাং সাভার ইপিজেড আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তরণ ঘটনার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য এলডব্লিউজিকে সরাসরি দায়িত্ব দিয়ে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তরণ ঘটাতে হবে।

তৃতীয় কারণ হিসেবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানিতে শুধু কতিপয় বড় কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে কখনোই সম্ভব নয়। প্রতিযোগিতাসক্ষম খাত হিসেবে দাঁড়াতে হলে তৈরি পোশাক খাতের মতো বিপুল সংখ্যক উদ্যোক্তা একসঙ্গে থাকতে হবে। তাহলে ব্র্যান্ড বায়াররা তাদের ইচ্ছেমতো পণ্য পছন্দ করতে পারবেন। সে ধরনের কোনো মার্কেট অবকাঠামো যতক্ষণ না হবে, কখনোই বড় মাপের শিল্প আশা করা যাবে না। সুতরাং মাঝারি-ছোটসহ অনেক বেশি কোম্পানি এখানে যুক্ত হতে হবে। প্রয়োজনে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। আর এজন্য অবশ্যই পরিবেশ মানদণ্ডে এগুলো উত্তরণ ঘটাতে হবে, ইটিপিগুলো ঠিক করতে হবে।

সরকারেরও এ বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতের উদ্যোক্তাদের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া দরকার ছিল, সহযোগিতার দরকার ছিল- তা হয়নি বললেই চলে। ফলে এ পণ্যটি দেশীয় বাজারমুখী খাত হিসেবে রয়ে গেছে। সুতরাং সরকার যদি চামড়াজাত পণ্যকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে গড়ে তুলতে চান তবে অবশ্যই রপ্তানিমুখী চামড়াকে দেশীয় চামড়া খাত থেকে আলাদাভাবে নিতে হবে। প্রয়োজনে রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্পনগরীকে আলাদা করে তৈরি করা যেতে পারে।