উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় পর রপ্তানি ও রেমিন্ট্যান্স কমবে: অধ্যাপক রেহমান সোবহান

Published in দৈনিকি ইনকিলাব on Tuesday, 27 March 2018

উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক মর্যাদা : চ্যালেঞ্জে বিদেশী বিনিয়োগ

হাসান সোহেল

এক সময়ের ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ, এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। দরিদ্র কিংবা স্বল্পোন্নত পরিচয়ের ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে নতুন পরিচিতি উন্নয়নশীল দেশের পথে অগ্রযাত্রা। যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানান সূচকে এগিয়ে যাওয়ারই অনন্য উদাহরণ। তবে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক এই মর্যাদা পাওযায় বাংলাদেশের সামনে কিছু নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরী হলেও নতুন কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে। অপরদিকে রপ্তানী আয়, বৈদেশিক ঋণ ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আসবে পরিবর্তন। থাকবে না বিভিন্ন সংস্থার সহজ শর্তে ঋণ এবং রপ্তানি পণ্যে বিশেষ সুবিধা। আর তাই বিনিয়োগ বাড়ানোসহ নানাভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ধনী-গরিবের বৈষম্য এবং আমলাতন্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

বর্তমানে তিন বিলিয়ন ডলারের মতো বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে এগোচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আর তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এই মর্যাদায় সম্ভাবনা যেমন বাড়ছে, রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জও। এছাড়া, নানান প্রতিবন্ধকতাও মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে। নতুন দায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে বিচার বিশ্লেষণ করে এগুনোই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ অনেকের। এদিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংস্থা আঙ্কটাডের হিসাব অনুযায়ী, এলডিসি থেকে বের হওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমতে পারে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে সাত শতাংশ পর্যন্ত। কেবল উন্নত এবং উন্নয়নশীল ২০ দেশের জোট গ্রæপ টোয়েন্টি থেকেই তাদের রফতানি আয় কমবে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশের বেলায় হিসাবটা হলো, শুল্ক সুবিধা দেয়া দেশগুলো তা তুলে নিলে, মোট রফতানি কমবে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাবে যা, দেড় থেকে সোয়া দুই বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে, বাংলাদেশকে বন্ধ করতে হবে রফতানিতে নগদ সহায়তাও। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে সস্তায় ঋণ পাওয়ার সুযোগও কমে আসবে বাংলাদেশের। তবে, এজন্য এখনো হাতে সময় আছে অন্তত নয় বছর। যাকে ঠিকমতো কাজে লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লষকরা। পাশাপাশি সরকারকে অব্যাহত রাখতে হবে দরকষাকষিও। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগের আশা ব্যবসায়ীদের। দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে নানান সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে এখনো। দুর্বল অবকাঠামো ও জ্বালানি সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যবসায় বাড়ছে খরচ। যা দেশি-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের বড় বাধা। তাই পদ্ধতিগত সংস্কার, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বন্দরে পণ্য খালাসে দীর্ঘ জটিলতার অবসান কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ইঙ্গিত দিলেন ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেন, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকলে বিদেশী বিনিয়োগও আসবে কি করে।

‘ইপিলিয়ন গ্রুপ’ দেশের অন্যতম প্রধান তৈরি পোশাক উৎপাদন এবং রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। গেলো দুই দশকে তাদের পণ্যের গন্তব্য হয়েছে ২৪টি দেশে। তবে, প্রায় ৯০ শতাংশই যাচ্ছে ইউরোপে। আর বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত হওয়ায়, এই পণ্য বিক্রির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটিকে গুণতে হচ্ছে না বাড়তি কোনো শুল্ক। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে এই সুবিধা উঠে গেলে খরচ বাড়বে বেশ খানিকটা। গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজউদ্দিন আল মামুন যাকে দেখছেনÑএই খাতের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে। তাই, তার চাওয়া হলো, এই ধাক্কা সামলাতে হলে, সরকারি এবং বেসরকারি খাত মিলে প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। সূত্র মতে, উন্নয়শীল দেশের প্রাথমিক মর্যাদা পাওয়ার নতুন চ্যালেঞ্জ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ। যদিও বিদেশী অর্থ টানতে দেশকে এগিয়ে রাখবে এই মর্যাদা। তবে, তার আগে দেশের পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রতিই গুরুত্ব দিলেন বিশ্লেষকরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় পর বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিবে। রপ্তানি ও রেমিন্ট্যান্স কমবে। এই খেতাব ধরে রাখতে বিদ্যমান বাধা মোকাবেলায় দেশে টেকসই গণতন্ত্র আর সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

সিপিডি’র ফেলো অর্থনীতিবীদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি উন্নয়নের ফলে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুবিধাজনক হতে পারে। তবে বাংলাদেশ আগের মত রেয়াতি সুদে ঋণ পাবে না। বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে একটি মিশ্র অর্থায়নে যেতে হবে যেখানে উচ্চ সুদে বেদেশিক ঋণ নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী অর্জনকে গর্বের বললেও সামাজিক বেষম্য দূর করার পাশাপাশি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগালে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। যদিও উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশ ২০২৭ সাল পর্যন্ত অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা বা জিএসপি পাবো বলে উল্লেখ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এক্ষেত্রে ওইসব দেশের সাথে আলোচনা চলছে বলে উল্লেখ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, বাইরে থেকে যদি ইনভেস্টমেন্ট আসে সে জন্য সরকার সাবসিডি দিচ্ছে, স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সরকারের একেকটা পলিসি আছে। যদিও যেভাবে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা ধীর গতিতে হচ্ছে। স্পেশাল ইকোনমিক যোনগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। দেরী করা যাবে না। বাইরের ইনভেষ্টগুলো যখন সঠিকভাবে কাজ করবে তখন বাইরের বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করেন মুনতাকিম আশরাফ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের থেকে বৈষম্য দ্বিগুণ হয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধুর সময় (১৯৭৪ সাল) জাতীয় আয়ে বৈষম্য ছিল দশমিক ২৪। বর্তমানে সেটা হয়েছে দশমিক ৪৮।’

বৈষম্য সমাজকে ভেঙে ফেলে মন্তব্য করে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ফাঁকটা হল এখানে, সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি থেকে যত টাকা পয়সা এসেছে, তা কি ১৬ কোটি লোকের কাছে না কি কিছু লোকের কাছে গেছে? এখন কিছু লোক বড় লোক হয়েছে, প্রবৃদ্ধি থেকে যা এসেছে, তা পাহাড়ের উপর দিয়ে গিছে, সমতল ভূমিতে পৌঁছায়নি।’

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বৈষম্য কমছে না, বেড়েছে। তিনি অঞ্চলভিত্তিক কর্মসংস্থান ও শিক্ষার বৈষম্য কমানোর তাগিদ দেন।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবীদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, এই ভাবমূর্তি বিনোয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি দেশে বিনিয়োগ করবে না কিনা, পাশাপাশি লাভ ক্ষতি ঝুঁকির এসেসমেন্টে উপাদান হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে আসলেই বিনিয়োগ হবে কিনা তা কিন্তু বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশের উপর নির্ভর করছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবীদ।

বাংলাদেশের অগ্রগতিতে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা এই স্বীকৃতির মাধ্যমে কমবে না বলে মনে করেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবীদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। মির্জ্জা আজিজ বলেন, জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে জাতি হিসেবে আত্মবিশ্বাস বাড়লেও ভবিষ্যতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটা ঐকব্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সরকারি কাজ কীভাবে ‘সমন্বয়ের মাধ্যম’ করা যায়, তার উপর গুরুত্ব দেন তিনি। পাশাপাশি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন মির্জ্জা আজিজ। দারিদ্র্য বিমোচনের হার ক্রমশ কমে যাওয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বেশি উদ্বেগের বিষয়, দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতির হারটা ক্রমশ কমে আসছে।