কিছু জায়গার শিল্প-কারখানা, ইপিজেড খুলে দেওয়া যেতে পারে: ড. ফাহমিদা খাতুন

Published in কালের কন্ঠ on Wednesday 22 April 2020

চাপ বাড়ছে কলকারখানা সীমিত আকারে চালুর

► দীর্ঘায়িত হলে গভীর হবে বিপর্যয়
► ক্রয়াদেশ চলে যেতে পারে প্রতিযোগী দেশে

অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার চাপ বাড়ছে দেশে। বেকারত্ব রোধ, দরিদ্রদের কাজের সুযোগ, অর্থনীতির ক্ষতি কমিয়ে রাখতে এ ধরনের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। দেশের বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিতে সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই দীর্ঘ সময়ের জন্য লকডাউন থাকলে অনেক মানুষ না খেয়ে মরবে, কাজ হারাবে শিল্প, সেবা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি সব উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে।

সরকারি নীতিকৌশল আর নিজেদের অদম্য প্রচেষ্টায় ভর করে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত দ্রুততার সঙ্গে সাফল্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরির সাহস দেখানো সম্ভব হয়েছে বেসরকারি খাতের এগিয়ে যাওয়ার শক্তির ওপর ভর করেই। করোনা সেসব তছনছ করে দিচ্ছে। বিশ্বের মতো করোনার আঘাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের মানুষও লড়াই করছে। একদিকে ভাইরাস থেকে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধ।

তবে লকডাউনের ধাক্কায় ভাইরাস থেকে বাঁচলেও কর্মহীন জীবন, অভাব ও দারিদ্র্য কড়া নাড়ছে এমনকি মধ্যবিত্তের দরজায়ও। পরিস্থিতি যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এরই মধ্যে ইউরোপের সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি লকডাউন সীমিত পরিসরে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া লকডাউন তুলে দিয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার পরও অর্থনীতির স্বার্থে লকডাউনই করেনি সুইডেন। চীন তো বেশ আগেই করোনা থেকে উন্নতির পরপরই সব ধরনের কার্যক্রমে ফিরেছে। তাইওয়ান, হংকং, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ন্ত্রণ উপযোগী এলাকার শিল্প-কারখানা বা অফিশিয়াল কার্যক্রম সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

যেহেতু বাংলাদেশ একটি উঠতি অর্থনীতির দেশ, এখানে বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ আছে। একটি বিরাট জনগোষ্ঠী বেসরকারি খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, অর্থনীতিও চলে এ বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে, তাদের দেওয়া করের টাকায়। তাই দীর্ঘমেয়াদে এসব কর্মকাণ্ড অচল থাকা মানে ব্যক্তি খাত বসে যাওয়া, বিপুল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হওয়া, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়া, সরকারের রাজস্ব আয় বাধাগ্রস্ত হওয়া। আর এর সব কিছুর যোগফল মন্দার দিকে ধাবিত হওয়া।

এই যেমন কুমিল্লা ময়নামতির কাছের একটি রপ্তানিমুখী জুতার কারখানা। জিহান ফুটওয়্যার নামের এ কারখানার জুতা যায় চীন ও ইউরোপে। করোনার কারণে দু-একটি দেশে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও মোটা দাগে এখনো রপ্তানি অর্ডার বাতিল হয়নি। তবে করোনার কারণে লকডাউন করায় কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্যগত সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া আছে। কারখানাটিতে চীনের কয়েকজন প্রকৌশলী কারিগরি সহায়তার জন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। মার্চ মাস থেকে কারখানা বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়েছে। চলতি এপ্রিল মাসের বেতনও দেওয়া হবে। তবে এভাবে চলতে থাকলে অর্ডার চলে যাবে অন্য দেশে। তখন তা ফেরানো কঠিন হবে। জিহান ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাদা আহমেদ রনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাস্থবিধি মেনে সীমিত পরিসরে কারখানা খোলা রাখা উচিত। অন্যথায় আমাদের অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে। আমরাও আর্থিকভাবে দুর্বল হব। কর্মীরা কাজ হারাবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন চিত্র রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক শিল্প-কারখানা ও ব্যবসার ক্ষেত্রে।

সরকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এগিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে। তার পরও সরকারকে এ টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার-করজ, কিছুটা কৃচ্ছ্রতা সাধন, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এর বাইরে বিদেশি দাতা সংস্থার কাছে হাত পাততে হচ্ছে। গত সোমবার অর্থমন্ত্রী এডিবির প্রধানকে ফোন করে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা চেয়েছেন। এভাবে কত দিন দেশের পাঁচ কোটি দরিদ্র মানুষ, তার সঙ্গে করোনার প্রভাবে আরো অন্তত আড়াই-তিন কোটি নতুন দরিদ্র মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখা সম্ভব হবে? তাই উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, সবাইকে সচেতন করা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার মধ্যে সীমিত পরিসরে কিছু কিছু শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে খুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ কাজের সহায়তায় লাগাতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পোল্ট্রি খাতের উৎপাদিত পণ্য ও জিনিসপত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় রাজধানী ঢাকায় আনা বা যেখানে বড় বড় বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে হবে। এরই মধ্যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দৈনন্দিন ব্যবহারের অপরিহার্য উপকরণের মজুদ শেষের দিকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও সোর্স প্রতিষ্ঠান থেকে ঠিকমতো সরবরাহ পাচ্ছে না। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, উৎপাদন না হওয়ায় সরবরাহ দিতে পারছেন না উৎপাদকরা। ফলে সামনের দিনগুলোতে নিত্যব্যবহার্য পণ্যেরও এক ধরনে সংকট হতে পারে শুধু উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে।

চট্টগ্রাম বন্দরে শিল্পের কাঁচামালবাহী অনেক জাহাজ এলেও চাহিদা না থাকায় বা কারখানা খোলা না থাকায় তা খালাস নিচ্ছেন না অনেকে। এতে বন্দরে জাহাজজট চলছে। বন্দরে কনটেইনার রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখে লকডাউন পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল করার কথা বলছেন প্রায় সবাই। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে, যাদের রপ্তানি অর্ডার আছে তাদের কারখানা সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার আভাস দিয়েছেন।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-বিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ও বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো এখন করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, পাশাপাশি লকডাউন সহনীয় করে সীমিত পরিসরে কারখানা খোলার ব্যাপারে নমনীয় হয়েছে। সবাইকেই বাঁচতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও লকডাউন হালকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদেরও এদিকে চিন্তা করা উচিত। এমন হতে পারে যে সীমিত আকারে কারখানা খুলে যেসব কর্মী সুস্থ, যাঁদের বয়স ৫০-এর মধ্যে, তাঁদের কিছু কিছু করে কারখানায় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। না হলে, অর্ডার বাতিল হতে থাকবে। আমাদের অর্ডার ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ায় চলে যাবে। এর ফলে মালিকরা ক্রমেই আর্থিকভাবে দুর্বল হবে, অনেকে কাজ হারাবে, বলতে গেলে চারদিক থেকে ক্ষতি শুধু বাড়তেই থাকবে।

রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিশেষায়িত অঞ্চল বলে পরিচিত দেশের ইপিজেডগুলোও এখন বলা যায় বন্ধ। ঢাকা ইপিজেডে একটি কারখানা ইউরোপ-আমেরিকায় মাস্ক, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের পোশাক বানানোর বিশেষ কাজের জন্য সীমিত পরিসরে চালু আছে। ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সোবহান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ইপিজেডে এমনিতেই নিরাপত্তা ও নিরাপদ স্বাস্থ্যের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন উদ্যোক্তারা। তাই এখানকার কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে যাঁদের অর্ডার আছে তাঁরা চালু করতে পারেন। তবে সবই সরকারের শীর্ষ মহলের সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি জানান, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এখন অর্ডার আসছে হ্যান্ড গ্লাভস, ফেস শিল্ড, মাস্ক, পিপিইসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকরণের। এরই মধ্যে চট্টগ্রামে হ্যান্ড গ্লাভসের যে অর্ডার এসেছে, ওই কারখানার আর আগামী কয়েক বছর কোনো অর্ডার না নিলেও চলবে। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় ভাইরাস নিয়ে চীনের সঙ্গে তিক্ততা বাড়ছে। তারাও হয়তো চীন থেকে রপ্তানি কমাতে পারে। ফলে আমাদের সামনে রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়বে। তাই এখন যদি কারখানা দীর্ঘ সময়ের জন্য পুরোপুরি বন্ধ থাকে, তবে অর্ডার ফিরে যেতে পারে। যেহেতু ভিয়েতনাম ভালো অবস্থায় আছে, সেখানে পুরোদমে কাজ হচ্ছে, অর্ডার সব চলে যেতে পারে ওখানে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, এরই মধ্যে অনেকগুলো দেশ সীমিত আকারে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে যাচ্ছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতও এলাকা ও খাত বিবেচনায় কোথাও কড়াকড়ি আরোপ করছে, কোথায় লকডাউন সহজ করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করছে। তবে আমাদের এখানে জনবসতি বেশি। শিল্প-কারখানাও বেশির ভাগই জনবহুল এলাকায়, আবাসিক এলাকায়। তার পরও কিছু কিছু জায়গার শিল্প-কারখানা, ইপিজেডগুলোও খুলে দেওয়া যেতে পারে। চট্টগ্রাম, খুলনা বা গ্রামে—এ রকম জায়গায় যেখানে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেখানে কারখানা চালু করা যেতে পারে। যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় তখন না হয় তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

তিনি বলেন, কৃষকরা যে পণ্যগুলো উৎপাদন করছে, এগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিশেষ ব্যবস্থায় বাজারে আনা যেতে পারে। কারণ শহরে পণ্যের টান পড়ছে, অথচ গ্রামে পচে নষ্ট হচ্ছে বা ক্রেতা না পেয়ে ফেলে দিতে হচ্ছে। আর আন্তর্জাতিক বাজারের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। ভিয়েতনাম এত সফলতার সঙ্গে করোনা মোকাবেলা করেছে যে তারা সব খুলে দিয়েছে। তারা কিন্তু আমাদের প্রতিযোগী। এখন আমরা যদি এখন সীমিত আকারে কাজ শুরু না করতে পারি, তাহলে আমাদের রপ্তানিবাজার কিন্তু অনেকটাই হারিয়ে ফেলব।