শিশুদের বিপ্লব থেকে কী শিখলাম? – রেহমান সোবহান

Published in প্রথম আলো  on Sunday, 9 September 2018

শিশুরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সরকারব্যবস্থার নজরদারি ও জবাবদিহির অভাব আতঙ্কজনক মাত্রায় নেমে এসেছে

ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সপ্তাহখানেকের আন্দোলনেই আমাদের হৃদয়ে আশার পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। তারা আমাদের মনে এই বিশ্বাস আবার জাগিয়ে তুলেছে, হয়তো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হাতেই রয়েছে।

এখন এমন একটি সময় চলছে, যখন দেশের শাসনব্যবস্থার দুর্দশা দেখে বড়রা নির্বিকার ও নেতিবাচক অবস্থায় চলে গেছে। এ রকম একটি সময়ে এই শিশু-কিশোরেরা অন্যায়ের শিকার হয়ে আপন সমস্যা সমাধানে বড়দের মুখের দিকে চেয়ে থাকার প্রথাগত ধারণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা অসম সাহস নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। দীর্ঘদিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় যে সড়ক নিরাপত্তা, সেটি নিয়ে তারা যে শুধু স্লোগান দিয়েছে তা-ই নয়, এ সমস্যা সমাধানে কী কী করতে হবে, তা তারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রুগ্‌ণ শাসনব্যবস্থায় সংস্কার আনার ক্ষেত্রে শিশুদের এই আন্দোলনকে আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে রক্তক্ষয় ও অশ্রুপাতের মধ্য দিয়ে যেভাবে এর সমাপ্তি ঘটল, তা আমাদের সবার জন্য এক নিদারুণ অস্বস্তির বিষয় হয়ে থাকল।

গোড়াতে আমরা সবাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর নম্র ও সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছি। তখন আমাদের সবার মনে বিশ্বাস হচ্ছিল, এই শিশুরা আসলেই অনুসরণীয় এক মহা বার্তা বয়ে এনেছে। তাদের এই বার্তা অনুসরণ করে আমরা গোটা শাসনব্যবস্থার অন্যান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি আমলে নিয়ে সামনে এগোতে পারব।

শিশুদের এই মহতী উদ্যোগের সঙ্গে বিশদ পরিসরে বয়স্ক ব্যক্তিরা অর্থপূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করতে পারতেন। সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের জ্যেষ্ঠ নেতারা রাস্তায় নেমে প্রতীকীভাবে তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারতেন। বছরের পর বছর উপেক্ষা করে আসা সড়ক নিরাপত্তা আইন সংস্কার ও তা কার্যকর করতে তাঁরা কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা তাঁরা তুলে ধরতে পারতেন। তাতে শিশু-কিশোরেরা আশ্বস্ত হতে পারত। তাদের মনে এই বোধ জন্ম নিত যে তাদের আন্দোলন একেবারে নিষ্ফলা হয়নি; তখন তারা শান্তিমতো ক্লাসে ফিরতে পারত। তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নিত যে তাদের দাবি বাস্তবায়নে বড়দের সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ওপর ভরসা করা যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে অশুভ অপচ্ছায়ার মতো অস্ত্রধারীরা যেভাবে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং সহিংসতা ছড়িয়েছে, তাতে আমাদের জন্য আশাবহ একটি নতুন অবস্থা তৈরি হবে—এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের ঘরে ফেরা কঠিন ছিল।

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অপশাসনের কারণে এই তরুণেরা ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে অথবা তারা তাদের গর্বিত অথচ উদ্বিগ্ন বাবা-মায়ের কাছে কী বার্তা নিয়ে ফিরে যাবে, আমি তা আন্দাজ করতে পারছি না। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এই শিশুদের আন্দোলনে যে একেবারে কোনো লাভ হয়নি, তা নয়। এই আন্দোলনের জের ধরেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকার সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া আলোচনার টেবিলে তুলেছে। এ আইনটির খসড়া সাত বছর ধরে স্থবির হয়ে পড়ে ছিল।

অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের জন্য সংঘটিত বহুল আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও বিখ্যাত সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর আইনটির খসড়া তৈরি করা হয়। ওই ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার পর একইভাবে সারা দেশে বিক্ষোভ হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে তাড়াহুড়ো করে মূল আইনটি বানানো হয়েছিল। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল, ক্ষমতাধর মন্ত্রীদের নেতৃত্বে থাকা পরিবহনমালিক ও শ্রমিক ফেডারেশনগুলোর চাপের মুখে সেই আইন সিন্দুকবন্দী করে রাখা হলো।

আমাদের ছেলেমেয়েরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই সিন্দুক খুলে বিলটি বের করে এনেছে এবং শিগগিরই বিলটি পাসের জন্য পার্লামেন্টে ভোটে যাবে। এর জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হবে। দেশের স্বার্থে, বিশেষ করে দেশের শিশুদের স্বার্থে তাঁর এই পদক্ষেপের জন্য তাঁকে অভিবাদন জানাতে হবে। এ আইনটির সম্ভাবনার বিষয়ে যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন, এটি যে বিধিবদ্ধ হয়েছে, সেটিই ইতিবাচক অর্জন বয়ে আনবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের অন্যান্য আইনের মতো এ আইনটির মূল্য অধিকতর প্রতিষ্ঠা পাবে তখন, যখন এটিকে শুধু ঘোষণায় আটকে না রেখে বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।

বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝেছি, প্রথম কোনো কারণে এ ধরনের আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল কিংবা কেন বেশির ভাগ আইনই কদাচিৎ যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে—সেসব ভালোভাবে না জেনেই আমরা আইন প্রণয়ন বা পুনর্লেখনে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করি।

লক্ষণীয় হলো, এই দেশে আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার বিষয়ে রাষ্ট্রের অক্ষমতার বিষয়টি আমাদের শিশুরা এই অল্প বয়সেই বোঝার মতো প্রগাঢ় অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পেরেছে। তারা এমন এক অভিজ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে, যা বেশির ভাগ বড়রা দায় এড়ানোর জন্য এত দিন পাশ কাটিয়ে এসেছেন।

এই ছেলেমেয়েরা তাদের আন্দোলনে যে প্রধান স্লোগান আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’ ও ‘সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। তারা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, অল্প কিছুসংখ্যক অদক্ষ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন চালকই মূল সমস্যা নন, এই সমস্যা আরও গভীরে প্রোথিত। ত্রুটিপূর্ণ শাসনব্যবস্থাই এই সমস্যার মূল উৎস। শিশুরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সরকারব্যবস্থার নজরদারি ও জবাবদিহির অভাব আতঙ্কজনক মাত্রায় নেমে এসেছে। চালকেরা বৈধতার কাগজপত্র ছাড়াই গাড়ি চালাতে পারেন; কারও কাছে যদিও বা কাগজ আছে কিন্তু তাঁদের পেশাগত দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, যথাযথভাবে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই তাঁরা টাকাপয়সা দিয়ে বা অন্য কোনো কায়দায় এসব কাগজপত্র জোগাড় করেছেন।

আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে একটি আইন সবার জন্য প্রযোজ্য হয় না। যুগের পর যুগ এই পক্ষপাতমূলক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের আইনের শাসন পরিচালিত হচ্ছে। এই চিরন্তন সত্যটি আমাদের ছেলেমেয়েরা সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে। একটি বিষয় আমরা সবাই জানি এবং বলা যায়, যা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। সেটি হলো, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ, ভবন নির্মাণবিধি অথবা ঋণের অর্থ পুনরুদ্ধার করতে যেসব আইন রয়েছে, তা ঠিকমতো প্রয়োগ করা হয় না। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে আইন প্রয়োগ করা হয়। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের চাকরির প্রথম দিন থেকেই একচোখা বিচারের বিষয়কে আত্মস্থ করে ফেলেন। ফলে সবার সামনে আইন লঙ্ঘন করার পরও যখন কাউকে ছাড় দেওয়া হয়, তখন আমরা বুঝে নিই এই আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তি রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর লোক, সুতরাং আইন তাঁর জন্য অন্যদের মতো প্রযোজ্য নয়; তিনি ছাড় পেতেই পারেন।

অসহায় শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট পরে লাঠি হাতে যেসব যুবক হামলা চালিয়েছেন, তাঁদের পরিচয় নিয়ে কিছু জননেতা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকেই এসব দুর্বৃত্তকে তাঁদের ভালো করে চেনার কথা। আমার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট স্মৃতি থেকে বলতে পারি, অর্ধশতক আগে পাকিস্তান আমলে যখন আইয়ুব খানের শাসন চলছিল, তখন আমরা এই ধরনের অপরাধীদের সহজেই শনাক্ত করতে পারতাম। যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না, তখন সহজেই বোঝা যায়, তাঁরা শাসক দলের সহযোগী। আজকের মন্ত্রিসভার সদস্য রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, হাসানুল হক ইনু—তাঁরা সবাই আইয়ুব আমলে ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁরা ভালো করেই জানেন, পাকিস্তান আমলে আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে কীভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (এনএসএফ) ছেলেরা দাপিয়ে বেড়াত। গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য যখন তখনকার বীরোচিত ছাত্রনেতারা আন্দোলন–সংগ্রাম করতেন, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে এনএসএফের কর্মীরা যুক্ত হয়ে তাঁদের ওপর হামলা করতেন। সহিংসতা ছড়াতেন। আমাদের এই নেতারা তাঁদের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বহু আগেই জেনেছিলেন, এনএসএফ সদস্যরা যত বড় অন্যায়ই করুন না কেন, সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না।

একই ধরনের ঘটনা এরশাদ এবং বিএনপির আমলে দেখা গেছে। তখনো আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পুলিশ যখন নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে, তখন বোঝা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা ছাড়া আর কারও পক্ষে এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়া সম্ভব নয়।

পাল্টা আঘাতের মুখে পড়লে নিজেদের বাঁচাতে এই গুন্ডাপান্ডাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা দরকার হয়। নিজেদের কুকীর্তি থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যও তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দরকার হয়। এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে সংবাদমাধ্যমকর্মীদের সামনে সহিংসতা চালানোর পরও সাজা এড়ানোর সুযোগ পেতে তারা এসব সংস্থার ওপর নির্ভর করে। ক্ষমতাসীন যে রাজনীতিকেরা একসময় গুন্ডাদের দা এবং পুলিশের লাঠির সামনে আন্দোলন করেছেন, তাঁদের সেই অতীত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, যখন দুর্বৃত্তরা পুলিশের সামনে যাকে-তাকে হেনস্তা করে, তখন তাদের আসল পরিচয় কী। একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতায় নিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের পরিচয় নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল, তা সহজেই দূর করা যেতে পারত। যখন আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সশস্ত্র গুন্ডাদের মিশে গিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালাতে দেখেছি, তখনই প্রমাণিত হয়েছে, তারা ক্ষমতাশালীদের ঘনিষ্ঠ। তারা মুখোশ পরা নাকি হেলমেট পরা ছিল, সেটি আর তখন দেখার বিষয় থাকেনি।

এরপর আমরা দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। দুঃখজনক হলো, ক্যামেরায় যাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে, তাদের একজনকেও আটক করা হয়নি। এর আগে একইভাবে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রছাত্রীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে হামলা করতে দেখা গেছে। এসব সহিংসতা জনগণের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। বেছে বেছে শুধু এই ছাত্রছাত্রীদের (যাঁদের অনেকেই হামলার শিকার হয়েছেন) বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা প্রচ্ছন্নভাবে অন্যায় বলে সবার সামনে প্রতীয়মান হচ্ছে।

আমরা এর আগেও দেখেছি, যখনই কোনো গণ-আন্দোলন হয়, সেই মুহূর্তে নানা ধরনের খেলোয়াড় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এর মধ্যে ঢুকে পড়ে। স্মরণাতীতকাল থেকে বিরোধী দলগুলো এ ধরনের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে থাকে। অতি জনগুরুত্বসম্পন্ন ইস্যুগুলোকেও তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কোনো শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনকে কোনো দুর্বল রাজনৈতিক দল তাদের দুর্বলতর সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।

ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বশেষ নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সাইবার কার্যক্রমের জের ধরে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের জগৎ এমনই এক নতুন জগৎ, যার সঙ্গে আমার একেবারেই জানাশোনা নেই। আমার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নেই, এটি কীভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে আমার পরিষ্কার ধারণাও নেই। তবে আমি এটুকু জেনেছি, একুশ শতকে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চেয়েও অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। এই সাইবার জগতে সরকারের প্রতিটি কাজ ও উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়।

এ অবস্থায় সরকারের মাথায় রাখা উচিত, দেশের সব নাগরিক এবং সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তার বন্ধু নয়; সবাই শত্রুও নয়। তারা নানা ধরনের মন্তব্য করবে। কিছু সরকারের পক্ষে, কিছু বিপক্ষে যাবে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই খবর তৈরি করে না; তারা খবর আদান-প্রদান করে। সরকারের মাথায় রাখা উচিত, তার এমন কিছুসংখ্যক সমালোচক আছেন, যাঁদের সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যকে সর্বোচ্চসংখ্যক শ্রোতা-পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চান। কিন্তু সরকারের বিপক্ষে যায় এমন কোনো মন্তব্য করার জন্য তাঁদের সরকারের শত্রু ভাবার কিছু নেই।

আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বনন্দিত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এই শ্রেণিতে পড়েন। বহু বছর ধরে তিনি নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলনের ছবি তুলেছেন, যা তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সম্মান এনে দিয়েছে। বাংলাদেশে যাঁরা সচেতন নাগরিক আছেন; এবং যাঁরা শহিদুলের ফটোগ্রাফির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা সবাই জানেন শহিদুল উদার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল চেতনার একজন মানুষ। সারা জীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে তাঁর শিল্পকর্মকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একেকটি ছবির মধ্য দিয়ে তিনি যেভাবে একেকটি গল্প বলেন, তা আমার মধ্যে ঈর্ষা জাগায়।

যদি শহিদুল কোনো ঘটনায় আলোড়িত হয়ে ছবি তোলেন এবং সেই ঘটনা প্রশংসার চোখে দেখার মতো না হয় কিংবা তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরকার সম্পর্কে কিছু মতামত দেন, আমি মনে করি সেটা করার অধিকার তাঁর আছে। এটি তাঁকে সরকারের শত্রু কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী বানাবে না।

অতীতে আমাদের অনেককেই বিভিন্ন সরকার দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হলো, শেষ পর্যন্ত আমাদের মানমর্যাদা অক্ষুণ্ন অবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু আমাদের গায়ে এমন তকমা দেওয়া শাসনব্যবস্থা তাদের সুনাম অক্ষত রাখতে পারেনি। বর্তমানে ক্ষমতাসীন থাকা দলটির রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি আজীবন সহানুভূতিশীল একজন হিসেবে আমার শুধু দুঃখ হয় এই দেখে যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পথপ্রদর্শনমূলক রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে গেছি। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সরকারবিরোধী হিসেবে। বহু বছর ধরে তিনি নির্যাতন, স্বেচ্ছাচারী আটকাদেশ, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন। তিনি এমন এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগণতান্ত্রিক পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, যেখানে এ ধরনের অন্যায়-অবিচার রাষ্ট্র পরিচালনার যন্ত্র হবে না, যেখানে নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারকে দমন করে রাখা হবে না।

এই বৃদ্ধ বয়সে আমার রাজনৈতিক অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমি শুধু এই আশাই করতে পারি, তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের হাতে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন করার সময় এখনো আছে। পেশিশক্তি দিয়ে জনগণের আন্দোলন দমন না করে তাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসা ও সমর্থন জয়ের সময় এখনো আছে।

আমি মনে করি, সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে গিয়ে আটক হওয়া সব শিক্ষার্থীকে ছেড়ে তাদের সব ধরনের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত। কোটা আন্দোলনকারীসহ কিছু শিক্ষার্থীকে জামিনে মুক্তি দেওয়া একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচন করেছে। আমি মনে করি, শহিদুলকেও জামিনে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা করা উচিত। শহিদুলকে কারাবন্দী করায় দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

কোনো এক প্রাচীন ঋষি তাঁর অনুসারী নৃপতিদের উদ্দেশে কয়েকটি বাণী দিয়েছিলেন। সেগুলো আমাদের এই সময়েও প্রাসঙ্গিক। সেগুলো হলো:

সত্যিকারের শত্রুদের থেকে সত্যিকারের বন্ধুদের আলাদা করতে শেখো

শত্রুদের বন্ধুতে পরিণত করার চেষ্টা করো

এটা নিশ্চিত করো, তোমার বন্ধুরা শত্রুতে পরিণত হবে না।

 

গত ২০ আগস্ট ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত।  ইংরেজি থেকে অনূদিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত

রেহমান সোবহান অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান