শ্রমবাজারে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও বৈষম্যের শিকার – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 21 August 2022

সম্পত্তিতে নারীর নিয়ন্ত্রণে সামাজিক বাধাই বড়

সম্পত্তিতে নারীর নিয়ন্ত্রণে সামাজিক ও পারিবারিক বাধাই বড়। এক্ষেত্রে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। গতকাল সাংগাত ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সম্পত্তিতে নারীর অবস্থান (সম্পত্তির ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণ) বিষয়ক অনলাইন বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাংগাতের উপদেষ্টা এবং নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির। অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান, মেঘনা ব্যাংকের এমডি ও সিইও সোহেল আর কে হোসেন। সূচনা বক্তব্য দেন বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গত পাঁচ দশকে কিছুই হয়নি সে কথা আমি বলব না। অনেক জায়গাতেই সাফল্য এসেছে। নিজেরা করি দেখিয়েছে, প্রতিবাদ করে, নারীদের সংগঠিত করেও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। একথা সত্যি, এত অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ততটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি যতটা আমরা আশা করেছি। এজন্য সমাজের ভেতরটা কতটা অসহযোগী এবং সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের একটা পারিবারিক আইন আছে, যেটা ১৯৫০ সালে পাস হয়েছে। আইনটা খুবই ভালো। সেখানে নারীর খোরপোশ ও পারিবারিক অধিকারের কথা বলা আছে। আমাদের যেটা হয়, আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন।

তিনি বলেন, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার যত বাড়বে, ততই তার মোবিলিটি বাড়বে। ব্যাংকের অনেক সুবিধা আছে যেগুলো নারীরা পায় না। ব্যাংকাররাও নারীদের ঋণ দিতে ভয় পায়। এর কারণ হলো, ব্যাংকাররা অনেক সময় ঋণটা তুলে আনতে পারে না। এজন্য আমরা ওপর থেকে যেসব সুবিধা দিচ্ছি, সেগুলো ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এটা দেখার মতো একটা কাঠামো দরকার। এটা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। আমি দেখেছি, বর্গাচাষীরা টাকা পান না। ব্যাংকগুলোকে যতই বলা হোক না কেন তারা বর্গাচাষীকে টাকা দিতে চায় না। বর্গাচাষীর নিজস্ব জমি নেই। তাই ব্যাংকগুলো তাদের সামাজিক গুরুত্ব দিতে চায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পার্টনারশিপ করেছিল। এর মাধ্যমে বর্গাচাষীদের জন্য আলাদা করে ৫০০-৬০০ কোটি টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কয়েক লাখ নারীচাষী এ টাকা পেয়েছিলেন। আরেকটা বিষয় হলো, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম দাঁড় করানো দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৫ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পাবেন। এ টাকাটা তো ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ হবে। সেক্ষেত্রে কারা পেলেন, কতজন নারী পেলেন, এটার জন্য ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড করা কঠিন না। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনাও জরুরি। এক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে কীভাবে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যায় সেটাও ভাবতে হবে। নারীদের অধিকাংশেরই মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। তার মাধ্যমে তাদের ন্যানো লোন দেয়া যেতে পারে।

এর আগে সূচনা বক্তব্যে বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, এটা আমাদের তৃতীয় আয়োজন। আমাদের প্রথম অনলাইন বৈঠকে সম্পত্তিতে নারীর অবস্থান (খাসজমি এবং নারী) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় আলোচনার বিষয় ছিল উত্তরাধিকার ও নারী। নারী যেটুকু সম্পত্তি পাচ্ছেন, তাতে নিজের অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখি, আমার মা বা শাশুড়ি উত্তরাধিকার সূত্রে যেটুকু সম্পত্তি পেয়েছিলেন, পরিমাণে খুবই কিয়দংশ, সেটাও নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি, ভোগ করতে পারেননি।

সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, এরই মধ্যে যত আইন আছে, নীতিমালা আছে—এগুলো সবার কাছে পৌঁছানো দরকার। আমরা সবাই কিন্তু সব আইন জানি না। এক্ষেত্রে বণিক বার্তাসহ অন্যান্য গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। যেমন ৯৯৯-এর খুব ভালো ব্যবহার দেখেছি। স্কুলের ছাত্রীও জানে ৯৯৯-এ ফোন করলে সে সুরক্ষা পাবে। আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে স্কুলের ছাত্রীরা এখানে ফোন করে নিজেদের রক্ষা করেছে। এটা কীভাবে হয়েছে? ব্যাপক প্রচারের ফলে। তেমনি নারীবান্ধব নীতিমালাগুলোও সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, আজকের আলোচনার বিষয় হলো সম্পত্তির ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণ। আমরা যারা সভ্য, শিক্ষিত বলে নিজেদের দাবি করি, আমরা কি নারীর প্রাপ্য সম্পত্তিটুকু বুঝিয়ে দিতে পেরেছি? মুসলিম আইন নারীকে যতটুকু সম্পত্তি দিয়েছে, সেটাই কি নারীরা পাচ্ছে? পাচ্ছে না। এটা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিত্র। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সম্পত্তি বলতে শুধু জমিজমা নয়, চাকরি ও ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থও বোঝায়। নারীর উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছু আইনগত দুর্বলতা আছে, পাশাপাশি কিছু প্রায়োগিক সমস্যাও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার। কী ধরনের পরিবর্তন আসা দরকার, সেগুলো নারী নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলে আসছেন। আমি বলব, শ্রমবাজারে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এখানে তারা বৈষম্যের শিকার। এর মধ্যে মজুরি বৈষম্য অন্যতম। নারীরা এখন নতুন নতুন খাতে কাজ করছে। এজন্য তাদের সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার।

মেঘনা ব্যাংকের এমডি ও সিইও সোহেল আর কে হোসেন বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের থেকে যেসব সমস্যার কথা শুনলাম এগুলো খুব কমন সমস্যা। বহু বছর ধরেই এসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরা। ২০০১ সালের দিকে ইস্টার্ন ব্যাংক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এসএমই লোন দেয়া শুরু হবে। নারীও যে পুরুষের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে এ ধারণাটা আমাদের সমাজে নতুন ছিল। গত ১০-১৫ বছর বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক নির্দেশনা দিয়েছে, যাতে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। এগুলো যুগান্তকারী উদ্যোগ।

বৈঠকের শুরুতে তিন নারী উদ্যোক্তা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কুমিল্লার চান্দিনা থেকে যুক্ত হন কৃষি ও মত্স্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা লুত্ফুন নাহার। তিনি বলেন, ‘আমি সাবেক ইউপি সদস্য। আমি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মাছ চাষের পাশাপাশি পোলট্রি ফার্ম আছে আমার। ব্যবসার শুরুতে আমি কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যাই। চান্দিনা শাখায় ঋণের জন্য গেলে আমাকে বলা হয়, আপনি নারী, কী ব্যবসা করবেন, ফিশারিজ? আমি বললাম, একজন পুরুষ ব্যবসা করতে পারলে আমি কেন পারব না। কয়েকদিন ঘোরার পর আমার কাগজপত্র দেখে বলল, আপনি টাকা পাবেন তবে আপনার স্বামী বা ছেলেকে গ্যারান্টার হতে হবে। একজন নারী হওয়ার কারণে আমার সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমাকে ঋণ দেয়া হয়নি।’

নারী উদ্যোক্তা কোহিনুর বেগম যুক্ত হন রংপুর মিঠাপুকুর থেকে। তিনি বলেন, আমরা দুই বোন। আমার কোনো ভাই নেই। নারী বলে আমরা সমাজে এত অবহেলিত, যা বলার ভাষা নেই। খুব অল্প বয়সেই আমার বিয়ে হয়। আমি উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে করি। এটা শুনে আমাকে পরিবার থেকে বাধা দেয়া হয়। বলা হয়, তুমি মেয়ে, সন্তান মানুষ করাই তোমার কাজ। এরপর আমার মায়ের উৎসাহে উদ্যোক্তা হই। ব্যবসা ভালো হলে আমি বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করতে চাই। এজন্য আমার প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশনের দরকার হয়। মহিলা বিষয়ক দপ্তরে আমি রেজিস্ট্রেশনের আবেদন করি। সেখানে ভোগান্তির শেষ ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে পায়ের জুতা ক্ষয় হয়ে যায় আমার। আমার কাছে ১০ হাজার টাকা ঘুস চাওয়া হয়। গরু বিক্রি করে ৬ হাজার টাকা দিয়ে তারপর আমি রেজিস্ট্রেশন করাতে পারি।

চামড়াজাত পণ্যের প্রতিষ্ঠান গুটিপার স্বত্বাধিকারী তাসলিমা মিজি বলেন, গুটিপা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এখানে মেয়েদের ব্যবসা করাটা ভালো চোখে দেখা হয় না। এখানে পদে পদে বাধা দেয়া হয়। এ বাধাটা পরিবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে, যেসব জায়গায় আমাদের যেতে হয় সব জায়গাতেই আমরা বাধার মুখোমুখি হই। ট্যাক্স, লাইসেন্সসহ বিভিন্ন কাগজ আপডেট করতে বাধার মুখে পড়তে হয়। এ জায়গাগুলো যে কতটা হিংস্র, আমি নোংরা বলব না, তাদের হিংস্রতায় মনে হয় ব্যবসা নারীর জন্য নয়। এ ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

অনলাইন বৈঠকটিতে সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বণিক বার্তার সহযোগী সম্পাদক এম এম মুসা।