সংক্রমণের পর্যায় দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না পারলে, অর্থনৈতিক সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে: তৌফিকুল ইসলাম খান

Published in দৈনিক ইনকিলাব on Monday 29 June 2020 

দুরবস্থায় নিম্ন-মধ্যবিত্তরা

করোনাভাইরাসের প্রভাব দেশে আয় কমেছে ৯৫ শতাংশ মানুষের : ব্র্যাক নতুন এই দরিদ্র শ্রেণীর জন্য প্রচলিত কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে সরকারের ভিন্নভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন : ড. হোসেন জিল্লুর

করোনার মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব। এর প্রভাবে দেশ এক কঠিন সময় পার করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবী এক অজানা শঙ্কা ভর করে চলেছে। এই মহামারি কবে নাগাদ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে সেটিও একরকম অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে চরমভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের জীবনমান, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন।

করোনায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপন নির্বিঘ্ন করতে সরকার, প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যদিও এখন কিছুটা স্তিমিত এই সহায়তা কার্যক্রম। তারপরও এসব মানুষ কোথাও না কোথাও থেকে সাহায্য পাচ্ছে বা কাজ পাচ্ছে। তবে দেশে করোনার থাবায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। এদের দিনযাপন অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছে। কারো সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কারো ব্যবসা নেই আবার কারো বেতন কমেছে। লোকলজ্জার ভয়ে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নেয়নি। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জীবনে চরম এক অনিশ্চয়তা ভর করেছে। তবে কমেনি যাতায়াত ভাড়া, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা সেবার খরচসহ দৈনন্দিন জীবন নির্বাহের খরচ। তারপর আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। তাই পুঁজিসংকটে নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যম আয়ের প্রতিটি পরিবার এখন দুরাবস্থায় পড়েছেন। জীবনধারণে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান সৃষ্টি করতে না পারার গ্লানি নিয়ে অনেকেই এখন রাজধানী ছেড়ে বাধ্য হচ্ছেন গ্রামে ফিরতে। রাজধানীর রাজপথে ট্রাকে মালামাল ভরে গ্রামে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য হরদম দেখা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের সহায়তায় এখনও সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। এখনই সরকার সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী সংকটে পড়তে যাচ্ছে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই অবস্থা আরও কিছুদিন চললে অনেক মধ্যবিত্ত যোগ হবে নিম্নবিত্তের তালিকায়। এই পরিস্থিতিতে রাজধানীতে বসবাসকারী অনেকেই ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। সংকটকালে নিম্নবিত্তের সমস্যা হয় না। তারা যে কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। উচ্চবিত্ত তাদের সম্পদের কারণে যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। যত সমস্যা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, করোনা পরিস্থিতির যে সময়টা আমরা পার হচ্ছি, তা কবে কাটবে আমরা বলতে পারছি না। এই সংক্রমণের পর্যায় আমরা যদি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না পারি, তাহলে অর্থনৈতিক সব সমস্যাই আরো ঘনীভূত হবে। সরকার দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে সহায়তা দিচ্ছে। আমাদের সম্পদ এতটা নেই যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও সহায়তা দেবে।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের দিক থেকে একজন চাকরিজীবীর শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। এ সময় যেন কাউকে চাকরিচ্যুত করা না হয়, সেই দিকে নজর দিতে হবে। এর পাশাপাশি যারা মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ী, তাদের ঋণসহায়তা দেওয়া যেতে পারে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ক্ষতি মেনে নিয়ে নিজেদের সঞ্চয় দিয়ে সংসার চালাতে হবে। তবে এসব পরামর্শই সাময়িক। যদি আমরা দ্রুত করোনা সংক্রমণ রোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে না পারি, তখন সব হিসাবই পালটে যাবে।

সূত্র মতে, বেসরকারি অফিসের চাকরিজীবী, ব্যাংক-বিমার কর্মকর্তা, মাঝারি মানের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা সবাই এখন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যিনি পোশাকের ব্যবসা করেন তার দোকান বন্ধ। যিনি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন, অনেকে বাসা থেকে অফিস করলেও সিংহভাগেরই কাজ প্রায় বন্ধ। যারা বিদেশ থেকে পণ্য এনে দেশে বিপণন করেন, তাদের ব্যবসাও বন্ধ। মাসের কোনো আয় নেই। সঞ্চয় ভেঙে খেতে খেতে তা-ও এখন তলানিতে। তাই করোনার থাবায় দেশে সবচেয়ে বেশি বিপাকে মধ্যবিত্তরা।

করোনা দুর্যোগে রাজধানী ঢাকার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় পার করছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। চাকরি বা ব্যবসা থাকে কি থাকে না, কারো চাকরি চলে গেছে, করোবা বেতন কমেছে-এই অনিশ্চয়তার মধ্যে পুরো জীবনটাই যেন আতঙ্কের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তাদের। পাশাপাশি রয়েছে বাড়িভাড়া পরিশোধের চাপ, সন্তানদের স্কুলের বেতনের চাপ, অন্যদিকে ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে চরমভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের জীবনমান, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। সামাজিক ও আর্থিক চাপে ভেঙে পড়ার উপক্রম তাদের জীবনব্যবস্থা।

তাই বিশাল জনগোষ্ঠী ইতোমধ্যে ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে চলে গেছে। মধ্যবিত্তরা ঢাকা ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে অর্থসংকটে ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের জন্য বাসা ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিংয়ে থাকেন মলয় দেবনাথ। বেসরকারি একটি ইংলিশ মাধ্যম স্কুলে চাকরি করেন তিনি। মলয় জানালেন, অনলাইনে ক্লাস চলছে। এরই মধ্যে স্কুলের বেতন অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। বাসাভাড়া দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

ঢাকার মিরপুরের শেওয়রাপাড়া বসবাস করতেন মাহফুজ ইসলাম। একটি বড় কোম্পানিতে করতেন গাড়ি চালকের কাজ। এখন তার কাজ পুরোটাই বন্ধ। প্রতিমাসে ১১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু এখন সেই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা প্রায় অসাধ্য হয়ে গেছে। তাই তিনিও পরিবার নিয়ে মাদারীপুরের গ্রামের বাড়ি ফিরে গেছেন। গ্রামে থাকলে প্রতিমাসে বাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়ে অন্তত দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে কাজ করেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বললেন, গত চার মাস ধরে ফ্ল্যাট বিক্রি নেই। বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে। যে কোনো সময় ছাঁটাইয়ের মুখোমুখি হতে পারি। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।

গুলিস্তানে বেড কাভার ও পর্দার দোকান আবুল কাশেমের। কয়েক মাস থেকে ব্যবসা নেই। কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিটাতে গিয়ে বিপাকে আছেন। ইতোমধ্যে বাসা চেড়ে দিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কবে নাগাদ এই অবস্থা থেকে উত্তোরণ ঘটবে এ নিয়ে চিন্তায় আছেন আবুল কাশেম।

ক্যাবল ব্যবসায়ী মিলন খান বলেন, দোকানে খুচরা বিক্রি হচ্ছে। যেহেতু বাড়ি নির্মাণ বন্ধ; দোকান ও গুদামের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। সামনের দিনগুলোতে কী হবে তা ভেবে খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। তিনিও ইতোমধ্যে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যবসা ভালো হলে আবার নিয়ে আসবেন বলে জানান।

এদিকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে সারা দেশে ৯৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে বলে সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ৫১ শতাংশের কোনো আয় নেই এবং কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। এছাড়াও, ২৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, মহামারির কারণে তারা অর্থনৈতিকভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সাধারণ ছুটির আগে জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মাসিক গড় আয় ছিল ২৪ হাজার ৫৬৫ টাকা। গত মে মাসে তা কমে ৭ হাজার ৯৬ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ আয় কমে ৭৬ শতাংশ। জরিপ মতে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলের মানুষদের আয় কমেছে বেশি। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ এবং শহাঞ্চলের মানুষদের আয় করেছে ৭৯ শতাংশ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, করোনা নতুন একটি দরিদ্র শ্রেণী সৃষ্টি করেছে। যারা ব্যবসা-চাকরি-পুঁজি হারিয়েছে। কারো কারো বেতন কমেছে। এরা বেশিরভাগই শহরাঞ্চলের। এদের জন্য প্রচলিত কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে সরকারের ভিন্নভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। যদিও এদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। তারপরও সরকারের উচিত এলাকাভিত্তিক বা পেশাভিত্তিক এদের চিহ্নিত করে বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে সহায়তা করা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব মানুষ হয়তো নতুনভাবে পেশা শুরু করতে পারবে। বেশিদিন না হলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে সহায়তার আওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।