মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in jagonews24.com on 23 May 2022

বাজেটে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও কর্মসৃজনে প্রাধান্য

স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসৃজনে প্রাধান্য দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। যা দেশের জিডিপির ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়লেও পরিধি বাড়ছে না। করোনাজনিত বাড়তি চাপ না থাকলেও আগের প্যাকেজগুলো চলমান থাকায় থাকবে ব্যয়ভার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের বাজেট প্রণয়ন সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ করোনাপরবর্তী দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে এবার ব্যতিক্রমী বাজেট ঘোষণা করতে হবে। এছাড়াও করোনার কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষদের নতুন করে বাড়তি সুরক্ষা দিতে বাজেটে থাকতে হবে বিশেষ উদ্যোগ। নজর রাখতে হবে মূল্যস্ফীতির দিকে।

আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে, গত ৯ মে প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অনেকটাই চূড়ান্ত করা হয়।

২০২১-২২ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এবার বাড়ছে ৭৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও সরকারি খাত থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ আসবে। বাজেটে টাকার অঙ্কে নতুন জিডিপির আকার হচ্ছে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ মোট ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৫৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ এবং ৩২ দশমিক ৭৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বিতরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত এবছর খাদ্যশস্য সংগ্রহে অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ।

এদিকে, মূল্য সমন্বয় করা না হলে আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন পড়বে। আর গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা না হলে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি মূল্য পরিশোধ এবং প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ভর্তুকি দেওয়ার জন্য অন্যান্য ভর্তুকি খাতে আগামী অর্থবছরে ১৭ হাজার ৩শ কোটি টাকা বরাদ্দের চিন্তা রয়েছে।

অন্যদিকে, সারের মূল্য সমন্বয় করা না হলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি প্রণোদনা বাবদ ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ বাবদ জিডিপির ১ দশমিক ৯০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে জিডিপির শতকরা ১ দশমিক ১৭ শতাংশ।

২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সে হিসেবে মোট আয় বাড়ছে ১১ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। আর আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে নন-এনবিআর থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। এবারের বাজেটে কর বহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, আসন্ন বাজেটে ২৮ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ঘাটতি ধরা হবে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি বছরের তুলনায় ৬ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা বেশি ধরে বেতন-ভাতায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে পণ্য ও সেবায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এই খাতে ৩৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

বাজেটে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ বাবদ রাখা হচ্ছে ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, চলতি বাজেটে যা ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, গত ৯ মে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বাজেট উপস্থাপনের পর আর তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগামী বাজেটে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকির চাপ থাকবে।

‘বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসৃজন বেশি গুরুত্ব পাবে। তবে এবারের বাজেটে নতুন তেমন কোনো চমক নেই। করোনাপরবর্তী অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়েই এ বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়লেও পরিধি বাড়ানো হয়নি।’

‘আমাদের মধ্যে একটি অবজারবেশন হচ্ছে বয়স্ক ভাতার বিষয়ে। এই ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স সর্বনিম্ন ৬৫ বছর ও নারীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৬২ বছর হতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী সব মিলিয়ে ৭ শতাংশ। দেশে মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ধরলেও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখের মতো।’

তিনি বলেন, ‘মূলত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ ভাতা নেন। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ ধরলেও ৬০ লাখ মানুষ ভাতা নেওয়ার কথা। কিন্তু আমরা ভাতা দিচ্ছি ৬৪ লাখ মানুষকে। বয়স্ক ভাতার আওতা বাড়ানো হচ্ছে। বাজেটের বৈঠকে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এটি রিভিউ করতে বলা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, প্রতিবন্ধীদের ভাতা ১০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব উঠলেও সেটি বাড়ছে না, তবে আওতা বাড়ছে। সোশ্যাল সেফটি নেটের (সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী) কোনোটিই বাড়ানো হয়নি, শুধু আওতা বাড়ানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বাজেট রিভিশনের সুযোগ থাকবে। সে সময় পরিস্থিতির অনুযায়ী পরিধি বাড়তেও পারে, কিছু স্কোপ তো থাকেই।’

‘ইমারজেন্সি (জরুরি) কিছু লাগলে সেখান থেকে ব্যবহার করতে হয়। আর করোনার জন্য নতুন কোনো উদ্যোগ নিতে না হলেও আগের প্যাকেজগুলো কিন্তু চলমান। সেগুলো তিন বছরের জন্য করা হয়েছে, আগামী অর্থবছর পর্যন্ত এটি চলমান থাকবে। সেজন্য যত টাকা দরকার সেগুলো রাখা হয়েছে। এছাড়া কিছু বিষয় থাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। অন্যদিকে, আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, এবার এনবিআর থেকে ইলেট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিনের পরিধি আরও বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে। এর ফলে এনবিআরের আয় বাড়বে। খুচরা পর্যায়ে লাখ লাখ মেশিন বসানো ও রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যার জন্য বিকল্প উপায় চিন্তা করছিল এনবিআর।

‘সেই পরিপ্রেক্ষিতে এবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইএফডি মেশিন কার্যকর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইএফডির কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিং করবে। এজন্য তারা একটি নির্ধারিত কমিশন পাবে। এনবিআর শুধু আয়-ব্যয়ের ডাটা মনিটর করবে। প্রতিটি জেলায় একটি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কোম্পানি যত কম রেট দেবে তারা এই কাজ পাবে।’

আসন্ন এই বাজেট প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো নিউজকে বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি ঠিক আছে। যেহেতু মূল্যস্ফীতিজনিত প্রেসার (চাপ), মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, নতুন করে যারা কাজে ফিরছেন তাদের আয় সেভাবে পুরোদমে না ফেরা… সবকিছু মিলে আমাদের মনে হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কলেবর (পরিধি) বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। সেটি আকার ও পরিমাণ উভয় দিক থেকেই।

‘আমরা সিপিডির পক্ষ থেকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কলেবর বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছিলাম। সেটা যে বাড়েনি তা কিন্তু না, তবে প্রত্যেকটা আইটেম নির্দিষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। কিন্তু জিডিপির শতাংশ হিসাব করলে দেখা যাবে সেটি বাড়েনি, বরং কমেছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি যেভাবে ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ২৫, সেই হিসেবে বড় আকারে জিডিপির বিপরীতে গিয়ে যতটুকু সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ছে সেটি কম হওয়ার কারণে জিডিপির শতাংশ হিসেবে কম বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। যা বেড়েছে সেটি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে হয়। এখনো সরকার বিবেচনা করতে পারে। মধ্যবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলেও বরাদ্দ বাড়িয়ে অ্যাডজাস্ট (সমন্বয়) করার কথা ভাববেন। একইসঙ্গে এটাও উচিত হবে, যে কারণে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে, সেই জায়গাগুলো যদি অন্যান্য জায়গা থেকে অ্যাড্রেস করার প্রচেষ্টা থাকে।’

‘মূল্যস্ফীতি যদি সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা থাকে, অথবা বিদ্যুতের যেসব পণ্য ও সেবা ভোগ-দখলে বড় ভূমিকা রাখে সেগুলো যদি সীমিত আকারে তুলনামূলক কম রাখা যায়। যেমন বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সরকার যদি ভর্তুকি দিয়ে অ্যাডজাস্ট করে সেটাও প্রকারান্তরে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়িয়ে যদি সারের মূল্য না বাড়ানো হয় সেটাও কিন্তু প্রকারান্তরে ভোক্তা পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমদানিকৃত পণ্য, সেক্ষেত্রে ডলারের মূল্য যদি স্থিতিশীল রাখা যায় তাহলে সেটাও কম আমদানি ব্যয় নিশ্চিত করতে পারে, বিকল্প উৎসও হতে পারে। অথবা করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোরও সুযোগ রয়েছে সরকারের।’

গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, সরকারি যেসব প্রকল্পে কর্মজীবী নিয়োগের সুযোগ বেশি, সেসব প্রকল্প নেওয়া হলে তার মাধ্যমেও এই মূল্যস্ফীতিজনিত বাড়তি ব্যয়ের চাপটা কিছু হলেও সহ্য করতে পারে।