সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in যায় যায় দিন on 14 February 2024

ভয় দেখিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয়

দুরভিসন্ধি নিয়ে কোনো জিনিস অস্বাভাবিকভাবে বেশি পরিমাণে মজুত কিংবা অন্য কোনো কারসাজি করে কেউ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ালে প্রয়োজনে তাকে জেলে পাঠানো হবে- বাজার নিয়ন্ত্রণে ২২ জানুয়ারি এ হুঁশিয়ারি দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাত্র ৯ দিনের মাথায় বেশি দামে ধান বিক্রেতাদের হাতকড়া পরানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন খাদ্যমন্ত্রী। এর পরপরই দিনাজপুরসহ ধান উৎপাদনকারী বেশ কয়েকটি জেলাতে একযোগে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। তবে অবৈধ মজুতদার কিংবা বেশি দামে ধান-চাল বিক্রি করা বেশ ক’জন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হলেও ভর মৌসুমেও মোটা থেকে সরু সব ধরনের চালের দাম আগের মতো আকাশ ছোঁয়াই রয়ে গেছে।

মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে গ্রেপ্তার ও জেলের ভয় দেখিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তাদের ভাষ্য, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা। উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর- এই দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজার একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এ কারণে পণ্যের যে মূল্য তা বাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না। এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করছে এবং অনেক সময় সরবরাহকে প্রভাবিত করছে। তাই তারা যাতে নিজেদের ইচ্ছে মাফিক বাজার পরিচালনা করতে না পারে এজন্য সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে চাল, গমসহ বিভিন্ন ফসলের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিসংখ্যান চিত্র তৈরি করতে হবে। সেইসঙ্গে আগাম সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। তাদের শাস্তি দিয়ে বাজার বাগে আনার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হবে। বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠারও আশঙ্কা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

তাদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা খাদ্যমন্ত্রীর হুমকির পর ধারাবাহিক অভিযান এবং পরবর্তীতে চালের বাজার স্থিতিশীল না হওয়াসহ একাধিক বিষষে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যেও তার আভাস রয়েছে। সম্প্রতি তিনি বলেন, সরকার বড় কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিয়েছিল কম দামে চাল প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। তারা যদি ‘সত্যিকারের ব্যবসায়িক আচরণ’ না করলে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।

এদিকে চালসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাজার করপোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাওয়ার অভিযোগ তুলে এটিকেই মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। মোহাম্মদপুর সরকারি কৃষি পণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শহিদুলস্নাহ বলেন, করপোরেটগুলোর গুদামে কোটি কোটি বস্তা চাল মজুত রয়েছে। অথচ তাদের ধরা হচ্ছে না। সাধারণ ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে বাজার আরও অস্থিতিশীল হতে পারে।

কৃষি মার্কেটের এশিয়ান রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মিশকাদুর রহমান বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো যেভাবে মজুত করে, গোটা বাজার তাদের হাতে। তারা মিলারদের থেকে মাল কিনতে বিকালে অর্ডার দিলে রাতে ছেড়ে দেয়। করপোরেট ব্যবসায়ীদের থেকে মাল কিনতে গেলে অগ্রিম ডিও কিনতে হয়। মাল আসে ১০-১৫ দিন পরে। ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রেখে তারা সে টাকা দিয়েই চাল কেনে।

করপোরেট কোম্পানির মোড়কে চালের দাম বেশি দেওয়া হয় জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, কোম্পানির প্যাকেট চালের দাম কেজিতে ৮৫ টাকা। আর সাধারণ ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন ৬২ টাকা দরে। ২৩ টাকা পার্থক্য এক কেজি চালের মধ্যে। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।

সংকটের মূল জায়গায় হাত না দিয়ে গ্রেপ্তার ও জেলের ভয় দেখিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হলে আরও ‘হযবরল’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা। তাদের ভাষ্য, করপোরেট ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার টন মজুত পণ্যের দিকে নজর না দিয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের গুদামে হানা দিয়ে তাদের হাতে হাতকড়া পরানো হলে তারা ব্যবসাও বন্ধ করে দিতে পারেন। এতে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে।

এদিকে কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন সরকারের সদিচ্ছার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সমস্যার মূলে যেতে হবে। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এভাবে চিন্তা করা গেলে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। যদি রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মজুতদার বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কেননা তারা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থেকেই অপরাধ করে। সিন্ডিকেট হোক, মজুতদার বা অতি মুনাফাখোর হোক- তাদের অধিকাংশই সরকারদলীয় লোক। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে প্রশাসন কিছু করতে পারবে না।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার বলেন, দ্রব্যমূল্য জোর করে কমানোর কিছু নেই। বর্তমানে বাজারে যেভাবে মূল্যতালিকা দেওয়া হচ্ছে তা সঠিক নয়। যেসব তথ্যের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পিত চাহিদা নিরূপণ করা হয়, দেশে তা করা হচ্ছে না। আমাদের জনসংখ্যা কত, তাদের আয়-ব্যয় কত, খাদ্যাভ্যাস কী- এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই, গবেষণা নেই। জনসংখ্যা বেশি হলে পণ্যের ঘাটতি হবেই। জনসংখ্যার ভিত্তিতেই পণ্য আমদানি করতে হবে। দেশে কী পরিমাণ উৎপাদন করা দরকার, বাজারে কী পরিমাণ পণ্য ছাড়া দরকার- এসব বিষয় নির্ভর করে থাকে এর সংখ্যার ওপর। জনসংখ্যার সঠিক হিসাব না থাকা পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ। কেননা এক ধরনের জনসংখ্যার হিসাব ধরা হচ্ছে, অথচ প্রকৃত সংখ্যা আরেকটি।

বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে তিনটি কারণ থাকার কথা উলেস্নখ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথমত, টাকার অবনমন। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমলেও দেশে টাকার মূল্যমান অবনমনের কারণে তা কমছে না। দ্বিতীয়ত, বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতা নেই। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য বা প্রতিযোগিতা কমিশনের আরও সক্রিয় ভূমিকা দরকার। তৃতীয়ত, চাহিদা, উৎপাদন ও প্রয়োজন কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এতে কখন কী পরিমাণ পণ্য ছাড়তে হবে তার হিসাব পাওয়া যায় না। অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও চাহিদা কত, উৎপাদন কত ও কখন কতটুকু বাজারে ছাড়া হবে তার সঠিক তথ্য নেই। কখন কতটুকু আমদানি করতে হবে, সেসবের সমন্বয় নেই। এখানে অনেক দুর্বলতা আছে। ফলে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জেল-জরিমানার ভয় দেখানো হলেও বাজার মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কতটা দক্ষতা প্রদর্শন করছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বাজার পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, দুর্বল তদারকি ব্যবস্থায় বাজার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী মূল হোতাদের চিহ্নিত করা অসম্ভব। ফলে রাঘব বোয়ালরা অধরাই থেকে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টার্গেট ব্যর্থ হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর নাজনীন আহমেদ বলেন, গুরুত্ব না থাকায় মনিটরিং ব্যবস্থা কোনো কাজে আসছে না। মনিটরিং ব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব দুর্বল অবস্থায় চলে। যেমন ঢাকার বেশ কয়েকটি বাজারে নিয়মিত দাম মনিটর হওয়ার কথা। এক দিনের থেকে আরেকদিন দাম অস্বাভাবিক হলেই সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না।

এছাড়া সরকারের একটা মজুত আইনও আছে। এই আইনে বলা আছে চাল, ডাল বা শস্যের ক্ষেত্রে একজন ব্যবসায়ী কতদিন এবং কী পরিমাণ মজুত করতে পারবেন। কিন্তু এই আইন বাস্তবায়নের জন্য জনবল নেই।

এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বশীলরা কঠোর সাজার হুমকি দিলেও সত্যিকার অর্থে তা চায় কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন নয়। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন। সেটি করতে গেলে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পণ্য সরবরাহ, পণ্যের দাম ইত্যাদি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এখন একটি পণ্যের দাম বাড়ল, তখন হইচই পড়ে গেল আর সেই পণ্যের জন্য দু-একটা পদক্ষেপ নেওয়া হলো। এরপর আরেকটা পণ্যের দাম বাড়ল, এরপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকল। এটি এ দেশে নতুন কিছু নয়। এখন সামগ্রিক একটা ব্যবস্থাপনা বা কাঠামো থাকলে সিন্ডিকেটের সুযোগ নেওয়া কঠিন হতো। সেই ব্যবস্থাপনা থাকলে, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয়। কোন দেশের পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, কী ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়, কোন দেশ থেকে পণ্য আনতে কেমন সময় লাগবে- এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এখন পণ্যের দাম বাড়ে, আমদানির সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে নিতেই ভোক্তার পকেট খালি হয়ে যায়।