সুশাসনের অর্থনীতি রূপান্তরের বাংলাদেশ – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in খবরের কাগজ on 19 October 2023

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাজেট ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। জানা কথা, বাংলাদেশে কর ও রাজস্ব আহরণ থেকে আয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম (১২৩টি দেশের মধ্যে ১১৯তম স্থান)। রাজস্ব আয়ের প্রায় পুরোটাই চলে যায় আবর্তক (রাজস্ব/পরিচালন) ব্যয়ের পেছনে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্ত মোটামুটি শূন্যের কাছেই থাকে। তাই এডিপির বাস্তবায়ন মূলত সম্পূর্ণই বহন করতে হয় ঋণের টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ক্ষেত্রেও এ ধারাবাহিক প্রবণতার ব্যত্যয় হবে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়ন হতে হয় অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে, যেমন- সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক খাত থেকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের মাধ্যমে অথবা বৈদেশিক (দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়) বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত ঋণের টাকায়। অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে আসবে এডিপির প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৬৪.৩ শতাংশ আর বাকি ৩৫.৭ শতাংশ আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে।

মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ কাঠামোতে রেয়াতি ঋণের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে আর সুদের হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে; ঋণের শর্তও কঠিনতর হচ্ছে (যেমন, ঋণ পরিশোধের সময়- গ্রেস পিরিয়ড ও ম্যাচুরিটি পিরিয়ড- হ্রাস পাচ্ছে)। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার পরিমাণ টাকার অঙ্কে, টাকার বিনিময় হারের অবমূল্যায়নের কারণে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অভিঘাত বেশি অনুভূত হবে বৈদেশিক অর্থায়নে- প্রসূত যেসব প্রকল্প থেকে আয় হয় প্রধানত স্থানীয় মুদ্রায়, সেসব বিনিয়োগে। বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার জন্য রাজস্ব বাজেটের ব্যয়ের পরিমাণও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের দায় পরিশোধের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২৩৭৬.০ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দের তুলনায় ৩২.৮ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতির বহুমাত্রিক চাহিদার নিরিখে বড় অঙ্কের উন্নয়ন ব্যয় অস্বাভাবিক নয়। এবং এ কথাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় জিডিপির শতাংশ হিসেবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম (মাত্র ১৫ শতাংশের কাছাকাছি)। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, বিভিন্নমুখী সরকারি সেবার প্রাপ্তি, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি, ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সরকারি বিনিয়োগের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে বড় ধরনের সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে৷ স্কুল-হাসপাতাল নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্যাস সরবরাহ, যোগাযোগ-পরিবহনের উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ– এসবের অর্জন মূলত নির্ভর করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির গুণসম্পন্ন বাস্তবায়নের ওপর। কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, আয় ও সম্পদবৈষম্য হ্রাস করে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মানসম্পন্ন বাস্তবায়নের বড় ভূমিকা রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের ১৭টি অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্য অর্জনের যে অঙ্গীকার বাংলাদেশের আছে, সে প্রেক্ষিত থেকেও এডিপির সুশাসনভিত্তিক বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সরকার প্রণীত মধ্যমেয়াদি বাজেটারি কাঠামোর সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, চলমান অর্থনৈতিক চাহিদার নিরিখে খাতভিত্তিক বণ্টনের যে অগ্রাধিকার নির্ধারিত হয়েছে তার যৌক্তিকতা কতটুকু সঠিক এবং সর্বোপরি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থ সঠিকভাবে ব্যয়িত হচ্ছে কি না, সময়মতো ব্যয় হচ্ছে কি না এবং সুশাসনের সঙ্গে ব্যয় হচ্ছে কি না, সেসব প্রশ্ন। স্বীকৃত সত্য যে, উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রণীত হলে এবং মানসম্পন্নভাবে বাস্তবায়িত হলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে। এটা নিশ্চিত করা গেলে প্রাক্কলিত আর্থিক রিটার্নের নিশ্চয়তা এং উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না এবং ঋণ পরিশোধের দায়ভার অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলেই অর্থনীতি বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে- নাগরিক সুবিধার প্রাপ্যতা কমে যায়, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ অনুৎসাহিত হয়, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা স্তিমিত হয়ে পড়েন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং এর ফলে অভ্যন্তরীণ রিটার্নের হার, ইকোনমিক রিটার্নের হার এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিটার্নের হার প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে হ্রাস পায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতেই ঋণের টাকা পরিশোধ অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে ওঠে। বৈশ্বিক উন্নয়ন অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এসব কারণে একটা পর্যায়ে কোনো কোনো দেশ ঋণের ফাঁদে (ডেট ট্র্যাপ) পড়ে এবং ফলে একটা সময়ে সেসব দেশ মধ্য আয়ের ফাঁদে (মিডল ইনকাম ট্র্যাপ) আটকে যায়। উন্নয়নের একটা পর্যায়ে উন্নিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এসব অর্থনীতি দশকের পর দশক এক জায়গায় স্থবির হয়ে থাকে। বাংলাদেশকে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে, যাতে এ ধরনের একটি ভবিষ্যৎ পরিহার করে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা যায়।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১২৫০টি; তার মধ্যে ১১৬৭টি বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ প্রকল্প। যোগাযোগ, শক্তি ও এনার্জি, শিক্ষা, বাসস্থান ও কমিউনিটি সার্ভিসেস এবং স্থানীয় সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন- এই পাঁচ খাতে গেছে মোট এডিপির তিন-চতুর্থাংশ। রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ আছে মোট এডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৮.৪ শতাংশ)। অগ্রাধিকারের বিবেচনায় যেসব খাতকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন তার নিরিখে এডিপিতে খাতভিত্তিক বরাদ্দের প্রস্তাবনার যৌক্তিকতা আছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান চ্যালেঞ্জসমূহের বিবেচনায় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নগতির বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিলে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, বিশেষত যেসব বিনিয়োগে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা তুলনামূলকভাবে বেশি, সে ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হ্রাস টানার প্রয়োজন ছিল। তা করা হয়নি!

সিপিডির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পের মধ্যে একটি বড় অংশ (৪৭৩টি বা দুই-পঞ্চমাংশের বেশি প্রকল্প) আগেই সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। মেয়াদকাল বৃদ্ধি করা হয়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৬৯, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য দাঁড়িয়েছে ৪২৯-এ। এসব উদ্বর্ত (কেরিওভার) প্রকল্প ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার পর্যালোচিত হয়েছে; এগুলোর পেছনে ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে (কালক্ষেপণ মানেই ব্যয় বৃদ্ধি)। নীতিনির্ধারকরা বারবার এসব ব্যয় বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছেন। এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহের গড় বাস্তবায়নকাল ৪.৯ বছর। এক-চতুর্থাংশ প্রকল্পের (২৮৮টি) বয়স ৬ থেকে ১০ বছর। ৪৫০টি প্রকল্প এক থেকে চারবার সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে (৩৩৯টি একবার, ৮৪টি দুবার, ১৪টি তিনবার এবং ১টি চারবার)। ৮২০টি প্রকল্পের একটি আলাদা তালিকা রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের শ্লথগতি ও বারবার সময় বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির ওপরে যে নেতিবাচক অভিঘাত পড়ে তা বহুমাত্রিক– প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়; ঋণ পরিষেবার ব্যয় বাড়ে; প্রাক্কলিত ইতিবাচক ফল প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয় এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক রিটার্নের হার হ্রাস পায়।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাজেট বাস্তবায়নের শ্লথ অগ্রগতিজনিত সমস্যাসমূহ সাম্প্রতিক সময়কালে প্রকটতর হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৯০.০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল। এর পরবর্তী সময়ে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ হার ছিল ৮২.৬ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাজেট বরাদ্দের মাত্র ৫০.০ শতাংশ ব্যয়িত হয়েছে। ২০২৩-২৪-এর জন্য প্রস্তাবিত এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বাস্তবায়নের হার হতে হবে ৩০.০ শতাংশের বেশি। এই ব্যতিক্রমী ও উচ্চ বাস্তবায়ন হার অর্জন করার লক্ষ্যে কী কী সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হবে, তার কোনো পথরেখা অবশ্য বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি।

এর আগে বলা হয়েছে যে, বাস্তবায়নের এই নিম্ন হারের ফলে পরবর্তী সময়ে ঋণ পরিশোধের দায়ভার বৃদ্ধি পায় এবং এই ক্রমবর্ধমান দায়ভার অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করে। তখন আদায়কৃত রাজস্বের একটি বড় অংশই ব্যয় করতে হয় ঋণ পরিশোধে, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে তোলে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা ও সুশাসন আজ যেকোনো সময়ের তুলনায় তাই এত বেশি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের অধীনে যে সংস্থাটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেই আইএমইডি (ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুশন ডিভিশিন) তার বিভিন্ন পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনায় এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে। প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ে চিহ্নিত মূল সমস্যাসমূহের মধ্যে আছে: প্রকল্প বাছাইকালে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ও উপকারভোগীদের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া; প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক ও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব; প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ক্ষেত্রে পেশাদারত্বের অভাব; প্রকল্প বাছাইয়ের পূর্বে জেলা প্রশাসন থেকে জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক অনুমতি না নেয়া; মধ্যমেয়াদি বাজেটারি কাঠামো কর্তৃক নির্ধারিত সর্বোচ্চ অনুমোদিত আর্থিক সিলিং না মেনে প্রকল্প প্রণয়ন; প্রকল্পের বেসলাইন তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ না করা; প্রকল্পের ‘এক্সিট প্ল্যান’ সঠিকভাবে প্রণয়ন না করা।

বাস্তবায়ন পর্যায়ে সমস্যার মধ্যে আছে: ডিপিপিতে উল্লিখিত কর্মপরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা অনুসরণ না করা; বাস্তবায়ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব; প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব; প্রকল্প বাস্তবায়নসংক্রান্ত কমিটির সভা নিয়মিত না হওয়া; সক্ষমতার অভাব আছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কন্ট্রাক্ট দেয়া; সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টর কর্তৃক একাধিকবার বাস্তবায়ন সময়কাল দীর্ঘায়িত করার আবেদন; ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন; একই প্রকল্প পরিচালককে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ।

প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরবর্তী পর্যায়ে চিহ্নিত সমস্যার মধ্যে আছে: আইএমইডি কাছে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর নির্ধারিত প্রতিবেদন দাখিল না করা; প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না রাখা; প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সংরক্ষণ ও যথাযথ তত্ত্বাবধান না করা; প্রয়োজনীয় দক্ষ স্থানীয় জনবলের অভাবে বিদেশি কোম্পানির কাছে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে বাস্তবায়িত প্রকল্পের পরিচালনা হস্তান্তর।

এসব সমস্যা ধারাবাহিকভাবে অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে চার লেনের একটি সড়ক (আরবান আর্টারি রোড) নির্মাণে গড় ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি: যেমন- ভারত থেকে ৪.৪ গুণ, তুরস্ক থেকে ৩.৭ গুণ, চীন থেকে ১.৬ গুণ ও পাকিস্তান থেকে ২.১ গুণ। অনেক সময় যুক্তি দেখানো হয় যে, জমি অধিগ্রহণে বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশ থেকে বেশি ব্যয় এবং নদীমাতৃক বাংলাদেশে ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা অনেক বেশি রাখতে হয়। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে এগুলো অন্যতম কারণ। এসব কিছুকে বিবেচনায় নিলেও বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে ব্যয় যে তুলনামূলকভাবে বেশি, বুয়েটের একটি গবেষণা থেকে তার সত্যতা মেলে। সাম্প্রতিক অতীতে বুয়েট কর্তৃক পরিচালিত এই গবেষণা কার্যক্রমে ব্যয় মূল্যের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে একটি চার লেনের সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় (তখনকার হিসাবে) হওয়া উচিত ১২.০ থেকে ১৫.০ কোটি টাকা (১.৪ থেকে ১.৮ মিলিয়ন ডলার)। এর বিপরীতে দেখা যায় যে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ২১.০ কোটি টাকা (২.৪৭ মিলিয়ন ডলার) এবং রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ব্যয় হয়েছে ৫৫.০ কোটি টাকা (৬.৪৭ মিলিয়ন ডলার)। নির্মাণাধীন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ক্ষেত্রে এ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০.০ কোটি টাকা (৭.০৬ মিলিয়ন ডলার)।

অবশ্য বিষয়টি কেবল সড়কের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের জ্বালানি তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড় ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন, গ্যাস টারবাইন প্রযুক্তিতে চালিত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয়ের বৈশ্বিক গড় ৫৫১.০ ডলার, যেখানে বাংলাদেশের সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় ১১৭৭.০ ডলার আর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ব্যয় ৮১৯.০ ডলার।

যদিও এ কথা ঠিক, সাম্প্রতিক সময়ে ডিপিপি ফরমেটের উন্নত সংস্করণ প্রস্তুত করা হয়েছে; একই সরকারি কর্মকর্তা যাতে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে না থাকেন এবং প্রকল্প পরিচালক যাতে ঘন ঘন পরিবর্তন না হয়, সে জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ যাতে ডিপিপি প্রণয়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিচালনা করা যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রকৃত তথ্য উদঘাটনকে প্রণোদিত করার লক্ষ্যে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হয়েছে। অর্থ ছাড়ের জটিলতা নিরসনে নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। আইএমইডি কর্তৃক বাইরের পরামর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত পরিস্থিতির অবনমন হয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, উন্নত (ওইসিডিভুক্ত) দেশসমূহ অবকাঠামো বিনিয়োগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সরকারি বিনিয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামো প্রস্তুত করেছে এবং এই কাঠামো অনুসরণ করে সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কাঠামোতে ১০টি স্তম্ভ আছে: যেমন- অবকাঠামো নির্মাণে কৌশলগত অভীষ্ট নির্ধারণ; অবকাঠামো নির্মাণের প্রাধিকার নির্ধারণ; সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায় ও বিভাগের মধ্যে কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় বিধান; বিনিয়োগ কার্যক্রমে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; সম্ভাব্য বিভিন্ন উপকারভোগী গ্রুপের সঙ্গে মতবিনিময়ের ও তাদের বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডের পরিবীক্ষণ কাজে সংশ্লিষ্ট করার কাঠামো; ‘গুড ভেল্যু ফর মানি’ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ; বিনিয়োগকে টেকসই করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিটি পিলারে তিনটি প্রশ্নসাপেক্ষে বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগের মান উন্নত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন তিনটি হলো- সংশ্লিষ্ট পিলারটি কেন অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ; পিলারের সঙ্গে সম্পর্কিত নীতিমান্যতার মূল বিষয়সমূহ কী; এবং সংশ্লিষ্ট পিলারের নিরিখে বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত সূচকসমূহ কী। এ সুশাসন কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক ৪৭টি সূচকের মাধ্যমে উল্লিখিত ১০টি পিলারের প্রেক্ষিতে বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন ও মানগত উৎকর্ষের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। এসব সূচক প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল্যায়নেও সহায়তা করে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি ‘সুশাসন ফ্রেমওয়ার্ক’ বা ’সুশাসন কাঠামো’ প্রস্তুত করতে উদ্যোগ নিতে পারে এবং এ কাঠামোর নিরিখে সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার একটি বড় কারণ বাস্তবায়নকালে আইনি জটিলতার সৃষ্টি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনি লড়াই পরিচালনার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই পরামর্শক আইনজীবীদের সহায়তা নেয়া হয়ে থাকে, যা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে এসব মামলা দীর্ঘায়িত হয়, ফলে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। এ সমস্যার প্রশমনে বৃহৎ আকারের সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়সমূহের নিজস্ব আইন ক্যাডার গড়ে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রতিবছর যে ‘বার্ষিক পারফরমেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এপিএ) স্বাক্ষর করে থাকে, সে প্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ইস্যুকে কার্যকরভাবে সংশ্লিষ্ট করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি কর্মকর্তাদের প্রণোদনা ও পদোন্নয়নের সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতার বিষয়টিকে কার্যকরভাবে যুক্ত করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

আইএমইডি কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন পর্যালোচনার আলোকে যেসব পরামর্শ উঠে এসেছে, তা বিবেচনা ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। আইএমইডি কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার এখন সময় এসেছে বলে মনে হয়। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের জনবল ও দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন, প্রয়োজন নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং ল্যাবটেস্টিং সক্ষমতা বৃদ্ধি। আইএমইডির কর্মকাণ্ডে সচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তির ব্যবহার শক্তিশালী করতে পারলে প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা ও মান বৃদ্ধি পাবে এবং সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। অন্যান্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তার মধ্যে আছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের তাদের স্ব-স্ব এলাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকরভাবে যুক্ত করা; বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; স্থানীয় সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; প্রকল্পের উপকারভোগী জনগোষ্ঠীকে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যবেক্ষণ-প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান ও এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও নীতিমালা প্রণয়ন।

প্রারম্ভিক মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহের নিরিখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মান উন্নীত করা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, এক টাকা বাড়তি আয় ও এক টাকা ব্যয় সাশ্রয় শেষ বিচারে একই কথা। এটা ব্যক্তির জন্য যেমন সত্য, সরকারের জন্যও। আগামীতে বাংলাদেশের উন্নয়ন-চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে; জনগণের করের টাকায় বাস্তবায়ন করা সরকারি বিনিয়োগও সমান্তরালভাবে বাড়বে। বিনিয়োগ কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, প্রকল্পের মানসম্মন্ন বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সকল পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত করার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে দ্বৈত উত্তরণকালীন (মধ্য আয় ও এলডিসি গ্রাজুয়েশন) বাংলাদেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার টেকসই বাস্তবায়ন, ঋণের ফাঁদ এড়িয়ে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে অব্যাহত যাত্রা, এসডিজির অভীষ্ট ও লক্ষ্যসমূহের বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।

লেখক: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো