সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করা যাবে না – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিক বার্তা on 7 February 2024

বাংলাদেশের অন্যতম আর্থ-উন্নয়নবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। নতুন বছরে নতুন সরকারের সামনে কী কী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, মধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে কী করণীয়—এমনতর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

নতুন সরকারের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে নতুন যে সরকার এসেছে তার জন্য বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিগত বছরগুলোয় মূল্যস্ফীতির ফলে দেশের অর্থনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঋণখেলাপিদের থেকে ঋণ আদায় করা, ব্যাংকিং খাতে যেসব অনিয়ম চলছে তা বন্ধে কাজ করা নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। যেহেতু আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর তাই আমাদের অবশ্যই রিজার্ভ বাড়াতে জোর দিতে হবে। বর্তমানে আমরা আমদানি সংকুচিত করে রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা করছি, তবে এটা সঠিক বলে আমার মনে হয় না। কারণ দেশে যদি আমদানি কমে যায় তাহলে উৎপাদনও কমবে। পণ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের যে কাঁচামাল প্রয়োজন সেটা যদি আমরা আমদানি করতে না পারি তাহলে দেশে উৎপাদন ঘাটতি দেখা দেবে, ফলে আমাদের রফতানিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমদানি সংকোচনের ফলে রফতানি ছাড়াও দেশের অন্যান্য যে খাত রয়েছে যেমন কর্মসংস্থান, বৈদেশিক আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমদানি সংকোচন নীতির কিছু সুফল পেলেও দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে এর প্রভাব নেতিবাচক। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি সংকুচিত হবে। তাই আমি মনে করি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এছাড়া ডলার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণ করতে হবে। আমি মনে করি, এসব বিষয় নতুন সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির ওপর কেমন অভিঘাত পড়ছে বলে মনে হয়?

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক সূচক হিসেবে কাজ করে। যখন একটি দেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে তখন বিনিয়োগকারীরা সেই দেশকে পর্যবেক্ষণে রাখে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিষয়েও নজরদারি করে যে তারা কোথায় বিনিয়োগ করছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা যদি অর্থনৈতিক খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী না হয় তাহলে দেশের বাইরের বিনিয়োগ সেভাবে আসবে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে বর্তমানে আমাদের দেশে এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

আমরা উন্নয়নশীল দেশে পা রেখেছি, মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। সে লক্ষ্যে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আমাদের কী কী করা দরকার?

এখন দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমেই আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আমাদের বিশেষ সেবা চালু করতে হবে। যেমন যারা দেশে বিনিয়োগ করতে আসবে তাদের দাপ্তরিক কাজগুলো যেন সহজে সম্পন্ন হয় সেদিকে খেয়াল রাখা, এ খাতে যেসব নীতি রয়েছে সেগুলো স্পষ্ট করে উপস্থাপন করা, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে পরিষেবা সম্পর্কে তাদের অবহিত করা। তবে আমার কাছে মনে হয় এসব বিষয়ে ঘাটতির ফলেই দেশে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না। কারণ আমাদের এখানে এসব সেবা পেতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফলে এখানে বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে আমরা দেশে বিনিয়োগ হারাচ্ছি।

এছাড়া আমাদের প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতাও এর জন্য দায়ী হতে পারে। বিশেষ করে আমাদের এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থাও দুর্বল। এসব কারণে আমরা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না বলে আমি মনে করি। অন্যদিকে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সংকটের ফলে আমরা কিন্তু অনেক ব্যবসায়ীর পেমেন্ট প্রদান করতে পারিনি, এ বিষয়ও এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এক্ষেত্রে দেশের এক প্রকার অক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে। যার ফলে সামগ্রিকভাবে আমরা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না।

দেশে যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন ব্যাংক, বীমা, সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানসহ দেশে যেসব বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট সঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারছি কিনা, এসব বিষয় কিন্তু তারা পর্যবেক্ষণ করে। মূলত এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের চিন্তা করে। এ খাতে উন্নতির জন্য আমাদের অবশ্যই এসব বিষয় মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

তৈরি পোশাক ব্যতীত আর কোন কোন খাত বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সম্ভাবনাময়?

তৈরি পোশাকের পাশাপাশি সড়ক ও সেতু নির্মাণ বৈদেশিক বিনিয়োগের বড় একটি খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও বৈদেশিক বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনেও বৈদেশিক বিনিয়োগ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত যে খাতে আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারিনি সেটা হচ্ছে আমাদের শেয়ারবাজার। এক্ষেত্রে আমরা যদি দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারী করতে পারি তাহলে আমাদের আর্থিক খাতে একটি উল্লম্ফন সৃষ্টি হবে বলে আমার ধারণা।

এখন পর্যন্ত আমরা যেসব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ পেয়েছি এর বাইরেও দেশের স্বাস্থ্য খাতে সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা খাতেও এ বৈদেশিক বিনিয়োগ হতে পারে। কেননা জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের বৃহৎ একটি বাজার রয়েছে। এখানে বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোয় বিশেষ উন্নতির সুযোগ রয়েছে। যেমন এক্ষেত্রে আমরা বুয়েটের মতো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলতে পারি। বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এখানকার প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে আমরা আরো উন্নত করতে পারি। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাইরের বিনিয়োগ হলে দেশে বিদেশী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে। আমি মনে করি এসব ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ হলে দেশের সমুদয় অর্থনীতি সচল গতি ফিরে পাবে।

বাংলাদেশে অর্থনীতির আকার যেভাবে বড় হয়েছে, সেভাবে আমরা পুঁজিবাজার বড় করতে পারিনি। এর পেছনে কারণ কী?

সত্যি বলতে দেশে এখনো আমরা সুশাসনের অভাব বোধ করছি। আমরা দেখছি দেশের পুঁজিবাজার গুটি কয়েক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। তারাই পুঁজিবাজারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এই গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান বাজারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এবং তারাই এর সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে এমন একচেটিয়া প্রভাবের ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তারা অল্পতেই তাদের পুঁজি হারাচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করি বাজারে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে পুঁজিবাজার বড় করা সম্ভব না।

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটি হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ করা। আমরা যদি শিক্ষা খাতের কথা বলি সেখানে দেখবেন এ খাতে সরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে জিডিপির ২ শতাংশের কম। বিশাল জনসংখ্যার এ দেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ যদি হয় ২ শতাংশের কম হয় তাহলে আপনি কীভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করবেন? জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর তথ্যমতে, একটি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা খাতে অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। সে জায়গা থেকে চিন্তা করলে আমরা এ খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। উন্নত দেশগুলোয় কিন্তু শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের বরাদ্দ আরো বেশি।

অন্যদিকে যে ২ শতাংশ বরাদ্দ হচ্ছে তাও সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এ খাতের বেশির ভাগ ব্যয় চলে যাচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণে। দেখা যাচ্ছে যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণেই শিক্ষা খাতের বড় একটা অংশ ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষার মূল যে বিষয়গুলোয়—কারিকুলাম প্রণয়ন, গবেষণা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ল্যাবরেটরিসহ আরো অন্যান্য বিষয়—তেমন ব্যয় নেই। এদিকে আমাদের নজর দেয়া জরুরি বলে মনে করি।

শিক্ষার ক্ষেত্রে একদমই অবহেলিত দিক হচ্ছে গবেষণা ও নতুন উদ্ভাবনে। দেখা যাচ্ছে যে গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যয় একদমই কম। শিক্ষাকে কীভাবে আরো আধুনিক করা যায়, সে বিষয়ে নজর না দিলে আমাদের দেশে মানবসম্পদ তৈরি হবে বলে আমি মনে করি না। গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আমাদের আরো অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। আমরা ভৌত অবকাঠামোর ওপর জোর দিচ্ছি, কিন্তু মানবসম্পদের ওপরও জোর দিতে হবে। মানবসম্পদ যদি আমাদের শক্তি না হয়ে বোঝা হয়ে যায় তাহলে আমরা কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে এগোতে পারব না।

আমাদের রফতানি পণ্য ও রফতানি গন্তব্য সীমিত। সিংহভাগই যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে। চীন-ভারতসহ অন্যান্য বৃহৎ বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

দুটো দেশই কিন্তু উন্নয়নশীল। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুটো দেশে গিয়েছি। আমরা তো স্বল্পোন্নত দেশ। ফলে আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও শুল্পমুক্ত প্রবেশাধিকার পাই। আমরা কিছু পণ্য রফতানি করি। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো চীন নিজেই তো পোশাক তৈরি করে, রফতানি করে। এখন আমাদের দেখতে হবে চীন কী কী রফতানি করে না। একই কথা ভারতের ক্ষেত্রেও। মূল বিষয় হচ্ছে বাণিজ্য কখন হয়? আপনার কোন জিনিস আছে আর আমার কোনটা নেই। আবার আমার কোন জিনিস আছে যেটা আপনার নেই। এক্ষেত্রে আমি আপনার কাছ থেকে কিনব আর আপনি আমার কাছ থেকে কিনবেন। একই জিনিস থাকলে তো আর কেউ কিনবে না। তাই বাজার খুঁজে বের করতে পারলে পণ্যপ্রবাহ অটোমেটিকই চলবে। যেমন ইউরোপীয় বাজার আমাদের ওপর নির্ভরশীল। আমরা প্রকৃত দামে মানসম্পন্ন পণ্য তাদের কাছে সরবরাহ করতে পারছি। প্রতিযোগিতামূলক দামে দিতে পারছি। চীন-ভারত জনবহুল দেশ। তাই শুধু পোশাক নয়, আরো কী কী পণ্য বা সেবা আছে যা আমরা রফতানি করতে পারি তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে খুবই জোর দেয় এবং একের পর এক অবকাঠামো উন্নয়নও করছে। কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বা প্রয়াস কি যথেষ্ট বলে মনে হয় আপনার কাছে?

আমার কাছে মনে হয় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ দরকার। সেটা দেশীয় বিনিয়োগ হোক আর বিদেশী। বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য তো অবশ্যই বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু বিনিয়োগ কখন আসে একটি দেশে? তারা কেবল কাঠামো বানাতেই আসে না। এখানে পারিপার্শ্বিক বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে শারীরিক অবকাঠামোর পাশাপাশি মানবসম্পদও গুরুত্ব বহন করে। কেননা মানবসম্পদও একধরনের সফট অবকাঠামো। মানবসম্পদের দক্ষতা একটি অন্যতম ক্রাইটেরিয়া বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য। কারণ তারা বিনিয়োগ এবং এক্সপার্ট নিয়ে আসে কিন্তু সব মানবসম্পদ তো নিয়ে আসতে পারে না। আমাদের দেশের জনগণকে দিয়েই কাজটা করাতে হয়। সুতরাং বিনিয়োগ যেই করুক না কেন, প্রডাক্টিভিটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রডাক্টিভিটি যদি ভালো না হয় তখন সেটা কস্ট ইফেক্টিভ হয় না। আর প্রডাক্টিভিটি তখনই ভালো হবে যখন মানুষের দক্ষতা থাকবে। আবার বিনিয়োগের জন্য প্রযুক্তি আছে কিনা, রাজনৈতিক জটিলতা আছে কিনা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কতখানি আছে, দুর্নীতি আছে কিনা, এখনো দাঙ্গা হয় কিনা এসব বিষয়ও জড়িত। এর পাশাপাশি মানবসম্পদ জড়িত। এখন মানবসম্পদের জন্য আমাদের যে কিছু কিছু সরকারি ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার আছে, স্থানীয়দের মতে যারা এসব সেন্টার থেকে বের হয় তাদের কোথাও নিয়োগ দেয়া যায় না। কারণ তাদের দক্ষতা প্রয়োজনীয় পর্যায়ে পৌঁছয় না। সুতরাং ভোকেশনাল সেন্টারগুলো শুধু তৈরি করে রাখলেই হবে না। সেখানে কী পাঠদান করা হচ্ছে, কারা দিচ্ছে এগুলোর একসঙ্গে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ভবিষ্যতে এ মানবসম্পদের দক্ষতা না বাড়ালে হবে না। কারণ ভবিষ্যতে আমরা যখন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে যাব, তখন খুব বেশি জনসংখ্যার প্রয়োজন পড়বে না কোনো কোনো কাজে। রিপিটেড কাজগুলো অলরেডি এআই করে দিচ্ছে। এআই, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে। যেসব মানুষ ওই কাজগুলো থেকে চলে যাবে, ঝরে যাবে, তাদের নিয়ে আমরা কী করব? তাদের স্কিল তৈরি করে অন্য একটা জায়গা তাদের জন্য করে দিতে হবে। কিংবা তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে প্রযুক্তি খাতে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। নয়তো বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাবে। অলরেডি আমাদের যুবকদের বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের বেশি। প্রযুক্তি আমাদের স্বচ্ছন্দ্য দেবে, উৎপাদনশীলতা বাড়াবে ঠিকই, অন্যদিকে অনেককে কর্মচ্যুতও করবে। তাদের কীভাবে কর্মসংস্থান দেব বা আয় বর্ধনকারী কাজে যুক্ত করব, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি মূল্যায়ন করেন, তাহলে বিগত ২০২৩ সালটা বাংলাদেশের জন্য কেমন ছিল?

২০২৩ সালটা অর্থনৈতিকভাবে খুবই চ্যালেঞ্জিং বছর ছিল। সেখানে কিছু স্বল্পমেয়াদি সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং চলমান কিছু সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছিল। স্বল্পমেয়াদি সমস্যার মধ্যে ছিল মূল্যস্ফীতির চাপ, টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়া। এর পাশাপাশি কিছু কাঠামোগত সমস্যাও ছিল। যেমন রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা প্রতিভাত হওয়া, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঘাটতি। এগুলো আগে থেকেই চলে আসছে।এখানেও আমরা খুব একটা উন্নয়ন করতে পারিনি। সুতরাং আমাদের তাৎক্ষণিক কিছু সমস্যা, চলমান কিছু সমস্যা, দুটো সমস্যা মিলেই আমাদের অর্থনীতি চরম একটা অভিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে। যার কারণে মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সে অনুযায়ী তাদের বেতন বাড়েনি। ঋণখেলাপির মতো বহুল আলোচিত বিষয় তো ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি ব্যাংকের কিছু সূচক থাকে, যেমন ক্যামেল সূচক। অর্থাৎ এখানে মূলধনের পর্যাপ্ততা আছে কিনা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা কেমন। প্রায় সবকিছুতে ব্যাংক খাতগুলো দুর্বল। আমি যদি ভাগ করে দেখি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ব্যক্তি খাত ও বিদেশী ব্যাংকগুলো ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের ক্ষেত্রেই যে সূচকগুলো যে পর্যায়ে থাকার কথা সেটি নেই। আর রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তো আমরা কোনোভাবেই এগোতে পারছি না। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর দিলেও আমরা ২০২৩ সালে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দেখিনি। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথাটি জোর দিয়ে বলছি কারণ আমাদের যে ব্যাংক খাতের সমস্যা, ঋণখেলাপির সমস্যা, আমরা কোনোভাবেই কমাতে পারছি না। সেক্ষেত্রে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা আরো শক্তিশালী হওয়া, স্বাধীনভাবে কাজ করা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করা জরুরি। অর্থাৎ এ প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা যদি না কমানো যায় তাহলে এটা কাজ করতে পারবে না। আমাদের ব্যাংক খাত ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুর হবে। তেমনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, কর না দেয়া প্রভাবশালী ব্যক্তির থেকে কর আদায় করতে সাহস না পায়, তাহলে কিন্তু চলবে না। সাধারণ মানুষ যারা নিয়মিত কর দেয়, কর আদায় করতে শুধু তাদের পেছনে পড়ে থাকলে হবে না। প্রভাবশালী অনেকেই কর দেয় কিন্তু আমরা প্রায় শুনে থাকি অনেকে দেয় না, দেশ থেকে চলে যায় তাদের থেকে কর আদায় করার মতো স্বাধীনতা এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই। এখানে সংস্কার করাটা প্রয়োজন এবং এটা ২০২৩ সালে হয়নি। ২০২৪ সালে এগুলো করা উচিত। এমনিতে আইএমএফের যে শর্তে বিভিন্ন টার্গেট বেঁধে দেয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে দশমিক ৫ শতাংশ করে। কিছু অন্যান্য সংখ্যাগত টার্গেট আছে, নীতিমালাবিষয়ক টার্গেট আছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হলো আমি যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যদি না করতে পারি, তাহলে সমস্যা থেকে উত্তরণ হবে না।

নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

আমার প্রত্যাশা হলো মূল্যস্ফীতির চাপ যেন কমে আসে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার তা নিতে হবে। সাময়িক কষ্ট হলেও যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি কমে আসছে, সুদের হার বাড়াতে হবে। পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে গেলে, এ কষ্টটা দূর হয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো এটা আমার প্রথম প্রত্যাশা। আর আরেকটি প্রত্যাশা হলো, টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে বাজারে যে অস্থিতিশীলতা সেটা দূর হওয়া। খোলাবাজারে আমাদের ১২৫ টাকা ১২৪/১২৩ টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। আবার যারা ব্যাংক থেকে আমদানি করছে, তারা ডলার পাচ্ছে না। এজন্য আমরা বলেছি বাজারের হাতে বিনিময় হারটা ছেড়ে দেয়ার কথা। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলেছে তারা বাজারের হাতে ছেড়ে দেবে কিন্তু সেখানে এখনো মূল্য নির্ধারণ করার প্রবণতা রয়েছে। বাফেদা ও ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন বিনিময় হার নির্ধারণ করছে। কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। মূল্য নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে হয়তো ফ্ল্যাকচুয়েট করত যে আজকে দাম বাড়ল, কালকে দাম কমল কিন্তু এনোমেলি থাকত না যে একেকটা রেট একেকজনের জন্য। একটা জায়গায় গিয়ে স্থিতিশীল হতো। আমরা বলি যে বৈধপথে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের রেমিট্যান্স আসে না। এমনকি আড়াই শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়ার পরও আসে না। ৭-৮ টাকার পার্থক্য যদি থাকে তাহলে একজন প্রবাসী কেন তার কষ্টার্জিত টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে আনবে। অথচ আমরা যদি বাজারের হাতে ছেড়ে দিই, তাহলে ওই ইনসেনটিভ দেয়ারও প্রয়োজন হবে না। কারণ সেটাও তো সরকারের কোষাগার থেকে যাচ্ছে। বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে বাজারে ডলারও আসবে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে সুদের হার ও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার কথা বলব। আশা করি এ বছর তা বাস্তবায়ন হবে। আর চলমান সংকটের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু হবে। এটাই আমার প্রত্যাশা।