সে যা ছিল এবং যা হয়েছে তার জন্য আমি গর্বিত – রেহমান সোবহান

Originally posted in বণিকবার্তা on 20 November 2023

দেশের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মাননা দিতে যাচ্ছে বণিক বার্তা। খবরটা শুনে আমি আনন্দিত। সম্মাননা পেতে যাওয়া দুজনকে দীর্ঘ সময় ধরে চিনি। বিশেষ করে মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৭ সালে শিক্ষকতা শুরু করি, সে ছিল প্রথম ছাত্রদের একজন। আমাকে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে একটা কোর্স পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম ব্যাচে ছিল ফখরুদ্দীন আহমদ, সাইদ আহমদ, মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও মুহাম্মদ ইউনূস। তারাও তখন প্রথম বর্ষে ছিল। ফখরুদ্দীন আহমদ, সাইদ আহমদ ও মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ছিলেন ক্লাসের সব থেকে ভালো ছাত্র। তিনজনেই অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। যদিও জানতাম না মির্জ্জা আজিজ কোন ক্যারিয়ার বেছে নিতে যাচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক জানতাম, তার একটা ভালো ক্যারিয়ার হবে। কেবল ভালো ছাত্র ছিল না, ছিল সব দিক থেকে গোছানো। সে ফজলুল হক হলের ভিপি হয়েছিল। তার মানে সামাজিকভাবেও ছিল সক্রিয়। সব ভালো ছাত্রেরা এটা করতে পারে না।

সে সময় অর্থনীতি বিভাগ ভালো কিছু ছাত্র তৈরি করেছে, যারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেও সচেতন। ছাত্র রাজনীতিতেও ভালো নেতৃত্বের একটা সুবিধা ছিল, ভিন্ন ধরনের মানুষ ও ভিন্ন রাজনৈতিক চেতনা। মির্জ্জা আজিজ ছিল সেটারই প্রতিনিধিত্বকারী। তার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া হয়েছিল বুদ্ধিমত্তা, দায়বদ্ধতা ও সামাজিক সচেতনতার।

ভালো ছাত্রদের নিয়ে সাধারণত আশা থাকে, তারা শিক্ষকতায় আসুক। মির্জ্জা আজিজকে নিয়েও সেটা চেয়েছিলাম। কিন্তু তাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তখন অধিকাংশ ভালো ছাত্ররা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত। বেছে নিত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ফখরুদ্দীন, আজিজ ও সাইদ আহমদ—তিনজনই সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পেশা জীবনে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে। যতদূর মনে পড়ে মির্জ্জা আজিজ অল্প সময়ের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েও কাজ করেছে।

স্বাধীনতার পর মির্জ্জা আজিজ বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে চলে যায় পিএইচডি করতে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ হিসেবে। তারপর কিছু ট্রান্সন্যাশনাল কো-অপারেশনের হয়ে কাজ করে। এ সময় তার প্রকাশিত কিছু পেপার আমাকে মুগ্ধ করেছে। কাজের সূত্র ধরেই সে জাতিসংঘের হয়ে ব্যাংককে যায়। কাজ করে এসক্যাপের (দি ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক) ডেভেলপমেন্ট পলিসি ডিভিশনে। এ সময় তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ফের বাড়ে। সময়ে সময়ে সে বিভিন্ন সভায় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে কিছু প্রকল্পের সূত্রে।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করেছি তার পরিণত হয়ে ওঠা। কেবল একাডেমিক জায়গা থেকেই সে অর্থনীবিদ হয়ে থাকেনি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ে তার বোঝাপড়া ছিল স্পষ্ট। আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি হিসেবে। কাজের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে।

বাংলাদেশে এসে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অল্প সময়ের জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। সম্ভবত কিছুদিন সোনালি ব্যাংকের দায়িত্বেও ছিলেন। দেশে আসার পর আমাদের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। সে নিয়মিত আসতে থাকে সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) বৈঠকগুলোয়, দারুণভাবে আলোচনা এগিয়ে নিতে থাকে। সে সত্যিকার অর্থেই কাজের মানুষ। ম্যাক্রোইকোনমিকসে তার দখল অসাধারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা রাখে। প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। দক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব সামাল দিয়েছে। একাডেমিক মানুষ থেকে পুরোদস্তুর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে গেল। কিন্তু কোনো রকম ঘাটতি দেখা যায়নি প্রচেষ্টা আর মনোযোগের। হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছুই সম্ভব হয়নি।

অর্থনৈতিক বিষয়ে খুব দক্ষতার সঙ্গে বলতে পারত। গুরুত্বপূর্ণ পদে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিল। সাধারণত মানুষ দায়িত্ব না থাকার সময় যা বলে এবং দায়িত্বশীল অবস্থানে গিয়ে যা করে, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। কিন্তু এদিক থেকে আমি মনে করি তার ঘাটতি নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফল আসেনি, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ সেগুলো তার প্রচেষ্টা ছাড়াও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। সে অন্তত যা বিশ্বাস করেছে এবং যা লিখেছে, সে অনুযায়ী কাজ করেছে।

সবশেষে এটাই বলতে চাই, মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম একটা সফল ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন। তাকে দায়িত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তি হিসেবেই দেখেছি। একটা প্রতিভাবান, সম্মানিত ও নির্ভরযোগ্য ক্যারিয়ার তৈরি করেছে। সে যা ছিল এবং যা হয়েছে, তার জন্য আমি গর্বিত।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান