অর্থনীতির আকার অনুসারে ও উন্নয়ন কর্মকান্ড বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যথেষ্ট নয়: তৌফিকুল ইসলাম খান

Published in খোলা কাগজ on Friday 5 June 2020

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ে স্বাস্থ্যসেবা অধরা

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। বছরের পর বছর এ খাতে বরাদ্দ বাড়লেও অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে কার্যত খাতটি যথাযথ কাজে আসেনি। সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা অধরাই রয়ে গেছে।

চলতি বছরে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ রয়েছে ২৫ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়। যা মোট বাজেটের মধ্যে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আগের তিন বছরে স্বাস্থ্য বাজেটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২২ হাজার ৩৩৬ কোটি ও ১৬ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট রয়েছে ১২ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে  ৯ হাজার ৬০৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত ছয় অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে এডিপির বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় দুই গুন। প্রায় একই হারে বেড়েছে পরিচালন ব্যয়।  কিন্তু আনুপাতিক হারে সেবা ও সেবার মান বাড়েনি।

এ বরাদ্দ যদিও উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের ১০ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু এ বরাদ্দই যথার্থ কাজে আসেনি। পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর খোলা কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ একদিকে কম, অন্যদিকে প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে বরাদ্দ করা টাকাও সঠিক ব্যবহার করা যায়নি। চিকিৎসা যন্ত্রপাতি একদিকে প্রয়োজন মত না থাকা অন্যদিকে থাকলেও তা ব্যবহারের অনিহার কারণে নষ্ট হয়। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে মানুষ চিকিৎসা পায় না। সরকারি হাসপাতালে যে যন্ত্রপাতি ও ওষুধ রয়েছে সে সেবা নেওয়ার জন্যও ডাক্তাররা বাইরের ক্লিনিকে প্রেসক্রাইব করেন। সেখানে তারা কমিশন পান।

সরকারি হাসপাতাল তকমা হিসাবে ব্যবহার করলেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, বেশি আয়ের বেসরকারি ক্লিনিকই তাদের কাছে প্রিয়। মেডিকেল কলেজগুলোকে নৈতিকতা শিক্ষার পরিবর্তে টাকা রোজগারে বেশি জোর দেওয়ার এই পরিণতি। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সামাজিক এবং অনেকটা আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়ে গেছে।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও সেবার মূল্য বেশি হওয়ার কারণে সামর্থ্যবান মানুষই চিকিৎসা পাচ্ছে, গরিবরা চিকিৎসা নিতে পারছে না। তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্র ৩০ ভাগ বেসরকারি খরচে চিকিৎসা নির্বাহ হয়। আর ৭০ ভাগ ব্যক্তি পর্যায়ে। এই ৭০ ভাগের মধ্যে পুরোটাই প্রায় সামর্থ্যবানদের।

সিপিডির সিনিয়ার গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান জানান, অর্থনীতির আকার অনুসারে ও উন্নয়ন কর্মকা- বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। ফলে চিকিৎসা খাতে খরচ করতে করতে মানুষের খাদ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়গুলো প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে মানুষ কর্ম হারানোতে অবস্থার আরও তার অবনতি হয়েছে।

দেশে  মার্চ মাস থেকে করোনা শনাক্ত শুরু হলেও সরকার সময় মতো কাজ শুরু করতে পারেনি। ডাক্তারদের ট্রেনিং ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে সময় মতো প্রস্তুত করতে পারেনি। প্রয়োজন মতো টেকনিশিয়ান নেই। ডাক্তারদের মাঝে এক ধরনের বিদ্রোহী ও অপ্রস্তুত ভাব লক্ষ্য করা গেছে। ফলে করোনা রোগী শনাক্ত হলেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সরানো যায়নি। করোনা আক্রান্তের হার জ্যামিতিক হারে বেড়ে চললেও এখনো সে হারে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না, তিন মাস পার হলেও এখনো প্রয়োজন মতো টেস্ট করা যাচ্ছে না। মুুমূর্ষু যোগীকে চিকিৎস্যা দেওয়ার প্রয়োজনীয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই।

স্বাস্থ্য খাতের হাল নিয়ে খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রীই হতাশ। একনেকের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এ খাত নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন ভাবে আলোচনা করছেন। মনিটরিং করতে হবে, যন্ত্রপাতি কিনে অনেক সময় ব্যবহার করে না, এ ধরনের অভ্যাস বর্জন করা দরকার। আমি দেখে এসেছি। আমি অস্বীকার করি না। অন্যান্য খাতের মতো আমাদের স্বাস্থ্য খাতেও অনেক ঘাটতি আছে। এটা লুকিয়ে রাখার কোনো বিষয় নয়। এটাকে আপডেট করা খুবই দরকার।

স্বাস্থ্য খাতের জন্য বাজেটে যে বরাদ্দ থাকে সেটাও প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে মানুষের কাছে পৌঁছে না। করোনা মহামারিতে তা স্পষ্ট হয়েছে। চিকিৎসকের পেছনে সরকার খরচ কররেও দেখা যায় সরকারি হাসপাতালে তারা চিকিৎসা দেন না। একজন রোগীর পেছনে সর্বোচ্চ দুই মিনিট চিকিৎসা দিয়ে বাইরে টাকা রোজগারের জন্য প্রাইভেট চিকিৎসা দিতে বের হয়ে পড়েন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান খোলা কাগজকে বলেন, তিন মাসে করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবেলা করতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাজেটে কী পরিমাণ বরাদ্দ লাগবে তার প্রয়োজন নিরুপণ, বরাদ্দ এবং কীভাবে তা ব্যয় করা হবে আগামী বাজেটে স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাক্সিব্লিটি থাকতে হবে। যাতে প্রয়োজন হলেই খরচ করা যেতে পারে। টাকার অভাবে চিকিৎসা দিতে পারছে না, মানুষ এমন কথা শুনতে চায় না।