হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ আসায় আশানুরুপ হারে বাড়ছেনা রেমিট্যান্স – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in সময়ের আলো on 14 January 2024

হুন্ডিতেই অর্ধেক রেমিট্যান্স

প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি বাড়ছে। তবে জনশক্তি রফতানির হার অনুপাতে বাড়ছে না রেমিট্যান্স। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় বেশি টাকা পাওয়ার আশায় প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অবৈধ পথে অর্থ পাঠানোয় রেমিট্যান্স কমেছে বলে মত বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪০-৪৫ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে হুন্ডির মাধ্যমে।

এদিকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তৃতীয় গ্লোবাল বিজনেস সামিটে সদ্য বিদায়ি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের উপস্থিতিতে তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের ৬০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। এ ছাড়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক তথ্যে জানা যায়, বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ বিভিন্ন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত। এদের কারণে বছরে আনুমানিক ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছিলেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন দফা যৌথ অভিযান চালিয়ে ১৬ হুন্ডি কারবারিকে গ্রেফতার করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট। এ উপলক্ষে সে দিন সংবাদ সম্মেলনেটি হয়েছিল। এসব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে বছরে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স আসছে হুন্ডির আকারে।

অথচ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বাড়ছে জনশক্তি রফতানি, কিন্তু সে হারে বাড়ছে না রেমিট্যান্স। বিএমইটির তথ্য মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয় মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৫৯ জন। এর বিপরীতে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে জনশক্তি রফতানি হয় ৬ লাখ ১৭ হজার ২০৯ জন, আর রেমিট্যান্স আসে ২২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে জনশক্তি রফতানি হয় ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন, রেমিট্যান্স আসে ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। আর সবশেষ ২০২৩ সালে জনশক্তি রফতানি হয় ১৩ লাখেরও বেশি। এর বিপরীতে রেমিট্যান্স এসেছে ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২০ সালের পর তিন বছরে আরও ১০ লাখ ৮২ হাজার ৩৪১ জন বাংলাদেশি বিদেশে গেলেও রেমিট্যান্স বেড়েছে মাত্র ১৭ মিলিয়ন ডলার। যে হারে জনশক্তি রফতানি বেড়েছে সে অনুপাতে যদি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসত তা হলে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত বলে মত বিশ্লেষকদের।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানর সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন শনিবার সময়ের আলোকে বলেন, ‘জনশক্তি রফতানি যে হারে বাড়ছে, সে হারে রেমিট্যান্স বাড়ছে না কেন-এ প্রশ্নের সহজ জবাব হলো-ফরমাল ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেশি না এসে হুন্ডির মাধ্যমে বেশি আসায় রেমিট্যান্স আশানুরূপ হারে বাড়ছে না। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে সরকার। এ ছাড়াও একটি ব্যাংক নিজ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেশি টানতে এর চেয়েও বেশি প্রণোদনা দিচ্ছে। তবে তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এর কারণ দেশে ডলারের রেট একেক জায়গায় একেক রকম। ব্যাংক দিচ্ছে ১১০ টাকার মতো, সেখানে কার্ব মার্কেটে মিলছে ১১৭-১২০ টাকা। ফলে বেশি লাভের আশায় প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমেই বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে।’

বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স যাতে বেশি আসে এবং হুন্ডি ঠেকাতে করণীয় জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশে যারা হুন্ডি নামের অবৈধ কারবারে জড়িত রয়েছে সবার আগে তাদের ধরে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। এটি করা সরকারের জন্য খুব কঠিন কোনো কাজ নয়, শুধু সদিচ্ছা দরকার। কারণ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে কে কোন নম্বর থেকে বা কোন আইডি থেকে হুন্ডি করছে সেটি সহজেই বের করা যায় মোবাইল ট্র্যাকিং করে। সুতরাং সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলেই হুন্ডি রোধ করা যায়।’

তবে রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী রেমিট্যান্স কমার কারণ হিসেবে হুন্ডির পাশাপাশি আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেন। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘শুধু হুন্ডির কারণেই রেমিট্যান্স কমে না, এর পেছনে আরও কারণ রয়েছে। সম্প্রতি জনশক্তি রফতানি বাড়লেও আন্তর্জাতিক অভিবাসনের প্রথম বছরেই অভিবাসন কর্মী রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে না। অন্যদিকে বহুসংখ্যক কর্মী অভিবাসন করলেও কাজ করতে না পেরে বা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এর পরিমাণ প্রায় ৩১ শতাংশ। এসব কারণেও রেমিট্যান্স কমে। এ ছাড়া ব্যাংকের ওপর অভিবাসীদের আস্থা কমে গেছে, যা বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহকে প্রভাবিত করেছে।’

সংকটের মধ্যেই ডলার আরও ফুলেফেঁপে উঠছে : এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ টাকাকে আরও দুর্বল করে ডলার আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। দেশে ডলারের সংকট চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। বিদেশি এ মুদ্রাটির চাহিদা থাকায় সদ্য সমাপ্ত বছরে ধারবাহিকভাবে বেড়েছে দাম। বছরের শেষের দিকে সামান্য দর কমিয়েছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। তবে সংস্থা দুটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অনেক বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করেছে অধিকাংশ ব্যাংক। দুবার শাস্তির মুখেও পড়তে হয়েছে কয়েকটি ব্যাংককে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছিল ১০৭ টাকায়। অর্থাৎ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে দেশি মুদ্রার মান কমেছে ৩ টাকা।

এদিকে ব্যাংকগুলোয় ডলারের দামের হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে অনেক বেশি। কারণ অনেক ব্যাংক এবিবি ও বাফেদার নির্ধারিত দাম মানছে না। গত বছরের শেষের দিকে ১২৪ টাকা দিয়েও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে কয়েকটি ব্যাংক। ডলারের এ দাম তখনকার খোলাবাজারের চেয়ে ৫ টাকা ও বাফেদার নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রায় ১৪ টাকা বেশি ছিল।

অন্যদিকে খোলাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ ২০২৩ সালের শেষের দিকে খোলাবাজারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে ডলার বিক্রি করা হয়। এ সময় প্রতি ডলারের দাম ঠেকেছিল প্রায় ১৩০ টাকা। সদ্য সমাপ্ত বছরের অক্টোবরের শুরুতে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকায় ওঠে। এরপর দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে বিদেশি মুদ্রাটির দাম।

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলার বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি শুরু থেকেই ভুল ছিল। ফলে টাকার মূল্যমান নিয়ে বেশ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ইন্টারব্যাংক মার্কেটে ডলার-টাকার বিনিময় হারে বড় পার্থক্য বিরাজ করছে। অনেক আগেই ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। এসব সমস্যার সঙ্গে ব্যাংকিংয়ের কিছু সমস্যাও যুক্ত।

অন্যদিকে ২০২২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ২১ দশমিক ২১ শতাংশ। ওই বছরের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০৪ টাকা। আলোচ্য সময়ে এ মুদ্রার দাম বেড়েছিল ১৮ টাকা ২০ পয়সা।

এর আগে ২০২২ সালে ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনায় ছয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরেও ১০টি ব্যাংক বেশি দামে ডলার কেনে। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

অন্যদিকে ডলার সংকটের প্রভাবে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ। সংকট সমাধানে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আমদানি কিছুটা কমলেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে ব্যাপক হারে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে।

রিজার্ভ আরও কমেছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি ডলার। চলতি জানুয়ারি মাসের শুরুতে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। আকুর পেমেন্ট ও ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ১৫৬ কোটি ডলার।

ডলার সংকটের চাপ সামলাতে আমদানি পণ্যের এলসিতে পণ্যভেদে ৭৫ শতাংশ থেকে শতভাগ মার্জিন আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাবে কমে গেছে আমদানির পরিমাণ। ২০২৩ সালের অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বর মাসে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৩৪ কোটি ডলার। অন্যদিকে জুলাই-অক্টোবরে রফতানি বেড়েছে গত বছরের তুলনায় মাত্র ৩ শতাংশ।

এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত নভেম্বর মাসে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো ধার করা টাকার সুদহার বেড়েছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েকটি কারণে দেশে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি করা হচ্ছে বেশি। ডলার আয়ের চেয়ে এখন খরচ বেশি হচ্ছে।