শুধু করোনার কারণে ১৫ শতাংশ মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমায় চলে গেছে: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in কালেরকন্ঠ on Tuesday 14 July 2020

করোনার প্রভাব

‘গরিব’ হয়ে গেছে এক থেকে দেড় কোটি পরিবার

টিকতে না পেরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ শহর ছেড়েছে

করোনাকালের এই মহাসংকটে মানুষের আয়-রোজগার কমলেও কমেনি সংসারের খরচ। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। মাস গেলে বাড়িভাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন, চিকিৎসা ব্যয়, পানি ও বিদ্যুতের খরচ সবই কড়ায়-গণ্ডায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। করোনার মধ্যেও কমবেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। ব্যবসায়ে লোকসান হলেও মাফ নেই কর-ভ্যাট বা শুল্ক পরিশোধে। কিছু কিনতে গেলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে নিজের অজান্তেই একজন ভিক্ষুককেও হিসাব কষে বাধ্যতামূলকভাবে ভ্যাট জমা দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াতের খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়েই অনেকে এখন স্যানিটাইজার, মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন উপকরণ কিনছে।

সংসার চালাতে গত কয়েক মাসে অনেকে শেষ সঞ্চয়টুকুও খরচ করে নিঃস্ব হয়ে এখন ধারদেনা করছে। পুরনো দেনা শোধ করতে না পারায় পাড়া-মহল্লার দোকানে এখন বাকি চাইলেও দিচ্ছে না। আর্থিক সংকটে টিকতে না পেরে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটেছে বহু মানুষ। সেখানেও কাজ নেই। দিশাহারা হয়ে কী করবে তার পথ খুঁজে পাচ্ছে না তারা।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার কারণে অনেক মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমায় নেমেছে। করোনা সংকট দীর্ঘ হলে এই সংখ্যা বাড়বে। কবে এসব মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে আসবে তা অনিশ্চিত।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু করোনার কারণে ১৫ শতাংশ মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমায় চলে গেছে। যার যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে গত দু-তিন মাস চলতে পারলেও এখন দিশাহারা। করোনার শুরুতে সরকার কিছুটা সহায়তা দিলেও এখন আর তাতে আগের মতো গতি নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই চলছে। বাড়িবাড়ার মতো বড় ব্যয় অনেকের জন্য কষ্টকর। আবার স্বাস্থ্যজনিত ও খাদ্য ব্যয় এখন বেড়েছে। সব মিলিয়ে  সাধারণ মানুষের জন্য সীমিত আয় বা সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা কষ্টকর। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনা থেকে বাঁচতে সরকার ঘোষিত সাধারণ মানুষের জন্য এক হাজার ২০০ কোটি টাকার প্যাকেজ, কৃষকদের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ, গ্রামীণ এলাকাকে অকৃষি খাতে জড়িত করতে ও বিদেশফেরত মানুুষদের কর্মমুখী করতে তিন হাজার কোটি টাকা, এসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের সবটা এখনো পুরোপুরি দেওয়া হয়নি। এসব অর্থ দিতে ব্যাংকের অনাগ্রহ রয়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে কর্মীদের বেতন দিতে আগ্রহী হচ্ছে না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, গবেষণায় দেখেছি, করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় বা বন্ধ হওয়ায় নতুনভাবে এক থেকে দেড় কোটি পরিবারকে এখন গরিব হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পাওয়ার পর বলা যায়, অনেকে সংসার চালাতে সঞ্চয় ভেঙেছে। কারণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের গত কয়েক মাসে সঞ্চয়পত্র কেনার হার বাড়েনি, বরং ভাঙানোর হার প্রতি মাসেই বাড়ছে। করোনার কারণে আর্থিক সংকটে টিকতে না পেরে গড়ে বিভিন্ন শহরের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ গ্রামে চলে গেছে।

করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। লোকসানে পড়ে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। করোনায় খরচ কমাতে বাধ্য হয়েই অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে। অনেকের বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

লিসা ফুটওয়্যার লিমিটেডের বিপণন কর্মকর্তা পদে চাকরি করতেন হাফিজুর রহমান। তিনি জানান, করোনার কারণে লোকসানে পড়ায় খরচ কমাতে তাঁকেসহ ৯ জনকে ছাঁটাই করেছে কর্তৃপক্ষ। হাফিজুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাকরি না থাকলেও বাড়িভাড়া, ইংলিশ মিডিয়ামে (ইংরেজি মাধ্যমে) পড়া আমার দুই মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিল, পানির খরচ, বাসার সার্ভিস চার্জ এক পয়সাও কমেনি। করোনার কারণে পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্কসহ অনেক কিছু নতুন করে কিনতে হচ্ছে। এসবের সঙ্গে আমার বৃদ্ধা মায়ের সপ্তাহে দুবার ডায়ালিসিসের খরচ তো আছেই।’

করোনার কারণে বিক্রি কমে যাওয়ায় শাড়ির দোকানের বিপণনকর্মী মো. সুমনকে লোকসানে থেকেও মালিক এক মাসের বেতন দিয়েছেন। এরপর মে মাসে তাঁকে ছাঁটাই করা হয়েছে। সুমন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুঁজি নেই। নতুন চাকরি নেই। ব্যবসা করার জন্য একটি এনজিও থেকে ঋণ নিতে আবেদন করি। করোনার কারণে ঋণ আদায় হচ্ছে না বলে নতুন ঋণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে না তিন বেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

অনেকের অভিযোগ, করোনার মধ্যে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অনেকে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। রাজধানীর মিরপুর এলাকার শফিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক মো. শফিক কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার মধ্যে সরবরাহ কম হওয়ায় এবং অনেকে পণ্য মজুদ করায় দাম বেড়েছে। করোনার মধ্যে বাকি নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে বলে জানান তিনি।

স্কুলের বেতন : সরকারের নির্দেশে গত মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও এখন অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলাচ্ছে। দুই-চারটি ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানে ফি আগের মতোই আছে। বেশির ভাগ অভিভাবক ফি কমানোর বা মওকুফের আবেদন করেছেন। রাজধানীর নর্থ ব্রিজ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছায়েরা রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার ২০০।  গতকাল পর্যন্ত করোনার কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে বেতন কমানোর বা মওকুফ চেয়ে আবেদন করেছেন ৫২৩ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক।’

পরিবহন ব্যয় : করোনার কারণে অনেক পরিবহনে দুই সিট নিয়ে বসে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার বিমানেও যাত্রী কমানোর অজুহাতে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ বেড়েছে।