এলবাঃ জীবন্ত শিল্প

সবুক্তগীন

এডওয়ার্ডও কাক নামের এক মার্কিন চিত্রকরের কল্পনা দিয়ে সৃষ্ট একটি জীবন্ত শিল্প কর্ম হল ‘এলবা’ । এটি একটি খরগোশ। সাধারণ কোন খরগোশ নয়, গবেষণাগারে সৃষ্ট একটি বিশেষ ধরনের সৃষ্টি যা জীনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদা মাফিক তৈরি করা হয়েছে। ফরাসী জীনতত্ত্ববিদ লুই মেরী লউদিবাইন একটি খরগোশের ভ্রূণে এক বিশেষ ধরনের জেলি ফিসের জীনের মিশ্রণ ঘটিয়ে এই অপ্রাক্রতিক প্রাণীটির উদ্ভব ঘটান। এটা করা হয় অর্থের বিনিময়ে, একজন ধনী শিল্পীর কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার জন্যে। কাজেই এলবা নামের এই খরগোশটি এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণকারী কোন স্বাভাবিক প্রাণী নয়। বরং জীনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সৃষ্ট একটি সম্পূর্ণ নতুন এক প্রাণী। এলবার শরীরে স্বাভাবিক খরগোশের জীনের সাথে যোগ করা হয়েছে,  Acquorea victoria   নামক জেলি ফিসের GFP  জীনটি। যার ফলশ্রুতিতে  এই খরগোশটিকে নীল আলোতে সবুজ দেখায়, এটি জেলি ফিসের মতো সবুজ রঙের আভা ছড়ায়। এলবার জন্ম ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর জীনের সংমিশ্রণে নতুন প্রাণী সৃষ্টি করার এক পরিকল্পনার আওতায়, যেটিকে নাম করন করা হয়েছিল GFP Bunny।

জীন নিয়ে গবেষণা এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর জীনের সংমিশ্রণে নতুন নতুন প্রাণী সৃষ্টি কতটা নৈতিক সেই প্রশ্নটা অনেকেই তুলেছেন। এটা যেন সুকুমারের  বকছছপ বা হাসজারু । মানুষ এখন সৃষ্টিকর্তা।

এডওয়ার্ডও কাক তার এই তথাকথিত জীবন্ত শিল্প নিয়ে আলোচনার ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু ওনার দাবী- এই আলোচনা ও সমালোচনা বর্তমান প্রেক্ষিতে খুবই প্রয়োজন। কেননা প্রযুক্তি যেখানে অনেকের আয়ত্তে- সেখানে এর প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ ঘটবে। বর্তমানে Crispr Gene Editing পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রানির জীন পরিমার্জন করা সম্ভব। তাই একই প্রাণীর জীনে পরিবর্তন আনা সম্ভব- কিছু জীন যোগ বা বিয়োগ করে নতুন বৈশিষ্টের প্রাণী সৃষ্টি করা সম্ভব। আমরা জানি বা নাই জানি বিভিন্ন গবেষণাগারে গোপনে বা প্রকাশ্যে, সরকারী বা বেসরকারি ভাবে, ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রচেষ্টায় জীনগত পরিবর্তন সাধন করে অপ্রাকৃতিক, অতিপ্রাকৃতিক, অভাবনীয়, অস্বাভাবিক এবং অতিমানবীয় প্রানি সৃষ্টি করার চেষ্টা থেমে থাকবে না।

কিছুদিন আগে চীন দেশে থেকে জানা গেছে যে, Sino Gene Biotechnology Company একটি প্রশিক্ষিত কুকুর clone করে প্রশিক্ষিত কুকুরদের একটি দল গঠন করতে যাচ্ছে। কেননা তারা মনে করছে যে, এই প্রক্রিয়ায়, মাত্র ১০ মাসে পরিপূর্ণ স্কোয়াড পাওয়া সম্ভব। এতে করে প্রায় ৫ বছর সময় ও প্রশিক্ষণ ব্যয় সাশ্রয় হবে। তারা মনে করছে একটি ভাল মানের প্রশিক্ষিত কুকুরের জীনে প্রয়োজনীয় গুণাবলী আছে। তাই সেটাকে  Clone করলে একই গুণাবলী সম্পন্ন প্রায় প্রশিক্ষিত কুকুর পাওয়া যাবে। এখানে নতুন প্রানি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হল বিশেষ ধরনের জীনগত গুনাবলির প্রাণী সৃষ্টি যেগুলো দিয়ে কেবলমাত্র বিশেষ ধরনের কাজ করানো হবে। শুধু বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ সৃষ্টি- বিষয়টি অনৈতিক ও অমানবিক । এটাই প্রথম নয়, দক্ষিণ কোরিয়া ২০০৫ সালে প্রায় একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। বিভিন্ন গবেষক বা প্রতিষ্ঠান একই রকম উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ ধরনের কাজের জন্য বিশেষ ধরনের মানুষও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন অলিম্পিকে পদক পাবার জন্যে সাঁতারু মানুষ বা কয়লা খনিতে কাজ করার জন্য মানুষ শ্রমিক।

তাই বিভিন্ন চিন্তাবিদরা মনে করছেন বিষয়টি নিয়ে বৈশ্বিক সংলাপ দ্রুত হওয়া খুবই দরকার। জীন গবেষণা বিষয়ে কিছু সুস্পষ্ট অবশ্যপালনীয় নীতিমালা থাকা দরকার। জীন গবেষকদের অবশ্যই এর নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ধনী গরীব সবাই যেন এর সুবিধা পায় সেটি দেখতে হবে। জীন গবেষণা যেখানে বেশী প্রয়োজন সেখানে করতে হবে, তা হতে হবে সার্বিক মানব কল্যানে। কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিশেষ খারাপ উদ্দেশ্য সাধনে নয়। সর্বোপরি, সব তথ্য প্রকাশিত হতে হবে। কোন কিছু গোপন থাকা চলবে না। সারা বিশ্বের মনুসের স্বার্থ পরিপন্থী কোন ব্যবহার যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে -জবাবদিহি ও সংযোগ অব্যাহত থাকতে হবে। তবেই কেবল এটি নিরাপদ, মানবিক ও নৈতিক হবে- মুনাফামুখী-ক্ষতিকর হবে না।