Dr Debapriya Bhattacharya on governance, economy and political disturbance

Published in Jaijaidin on Wednesday, 11 February 2015.

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছা নিয়ে শঙ্কা

রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতিতে হোঁচট
অর্থনীতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে হলে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি প্রয়োজন সুশাসন

মেসবাহুল হক

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীল অবস্থা ও অগ্রগতি ছিল সন্তোষজনক। অন্যান্য বিষয়ে ভালো করতে না পারলেও নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশ। কিন্তু দ্রুতগতিতে ছুটে চলা এ সম্ভাবনাময় অর্থনীতি বারবার হোঁচট খাচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্যে। এভাবে হোঁচট খেলে একটি দেশের অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থনীতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে হলে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি প্রয়োজন সুশাসন।

বিশ্বের বিখ্যাত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার, গোল্ডম্যান স্যাকস, কোফেস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স তাদের প্রতিবেদনে ক্রমাগত এগিয়ে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিফলন ঘটেছে। তারা এও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার এ গতি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। তবে এর জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তজুড়ে দিয়েছেন তারা। শর্ত দুটি হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন উভয়ক্ষেত্রেই দেশ লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে।

বিশ্ববিখ্যাত আর্থিক ও বিনিয়োগ এবং ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস এরই মধ্যে ‘নেক্সট ইলেভেন’ অর্থাৎ একুশ শতকে যে ১১টি রাষ্ট্র নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এর মধ্যে বাংলাদেশকে রেখেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে জনগণ প্রস্তুত, রাজনীতিকরা কি প্রস্তুত? বিশেজ্ঞরা বলছেন, দেখে তো মনে হয় না রাজনীতিকরা প্রস্তুত। তারা বলছেন, দেশ এমন একটি সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে, যেখানে নেতিবাচক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে অনভিপ্রেত। তারপরও যেহেতু দেশের সব সঙ্কটের মূলে রাজনীতি, তাই এখন তাদের শুভবোধের ওপরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ফলে বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের আলোচনায় বসে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগুচ্ছিল তাতে করে ২০১২ সাল থেকেই প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ থেকে ৮ পর্যন্ত অর্জন সম্ভব ছিল। কিন্তু একমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতাই তা হতে দেয়নি। দেশ আজ ৬ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে করে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশও হবে না। তিনি আরো বলেন, দেশের বড় দুই দল যেভাবে পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে তাতে কারো কথা শুনবে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তাদের এক টেবিলে বসতেই হবে। তা-না হলে একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতির অকাল মৃত্যু ঘটবে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষক ড. আবুল বাসার বলেন, কোনো দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে প্রথম দিককার চিন্তা-ভাবনায় একদল ফরাসি চিন্তাবিদ তুলনা করেছিলেন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে। ‘ফিজিওক্র্যাট’ নামে পরিচিত এ চিন্তাবিদদের মতে, মানবদেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোও সে রকম। সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন দরকার সব কয়টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতাহীন সমন্বয়, যা প্রাকৃতিক নিয়মেই সম্পাদিত হয়ে থাকে, তেমনি একটি দেশের অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকার কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনের সুযোগ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বারবার নানা বাধার সম্মুখিন হচ্ছে। সেটা কখনো সক্ষমতা অর্জনের পথে বাধা, আবার কখনো অর্জিত সক্ষমতা পূর্ণ প্রয়োগের পথে বাধা। এভাবে বারবার হোঁচট খেলে একটি দেশের অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারে না। সুষ্ঠু শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপের জন্য যেমন দরকার বিভিন্ন উপাদানের, তেমনি অর্থনীতিরও দরকার নানা শক্তির। প্রবৃদ্ধির চাকার গতি নির্ভর করে এসব অর্জিত শক্তির ওপর। সে শক্তি অর্জনের জন্য দরকার বিনিয়োগ।

সরকারি খাতের বিনিয়োগ বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করে। সুশাসন না থাকলেও আশির দশকে ভৌত অবকাঠামোর কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, যা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নেয়া বাজার উদারীকরণ নীতির সঙ্গে মিলে প্রবৃদ্ধির চাকায় গতি এনেছিল। সেজন্যই আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বেড়েছে, যা পরের দশকে আরো ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৬ শতাংশে আটকে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন দরকার নতুন শক্তির, নতুন নতুন অবকাঠামো এবং সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ।

এদিকে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের শেষপ্রান্তিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) স্থানীয় প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬০৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যা এ সময় নিবন্ধিত ২৯১টি শিল্প ইউনিটের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ। এর আগে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৩৩৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। যা সে সময় স্থানীয় নিবন্ধিত ৩১৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ। অর্থাৎ দেশে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব কমেছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। একই সঙ্গে বিনিয়োগ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে।

তবে শেষপ্রান্তিকে যৌথ ও শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব বেড়েছে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাবিত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ সময় পর্যন্ত প্রস্তাবিত বিনিয়োগের বিদেশি শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ৩০টি। এর আগে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাবিত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের নিবন্ধিত শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ছিল ২৭টি।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমানে দেশের প্রধান দুটি সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। এ দুই কারণেই দেশে বর্তমানে বিরাজ করছে বিনিয়োগ-বন্ধ্যত্ব। বিনিয়োগ কমতে শুরু করে ২০১১ সাল থেকে। তাই প্রমাণিত হয় যে, এই বন্ধ্যত্বর জন্য রাজনৈতিক ডামাডোল বা হরতাল ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাও দায়ী। কিন্তু আগের ও বর্তমান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিবর্তনে সংস্কারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।