Dr Khondaker Golam Moazzem on revenue collection and politics

Published in Bhorer Kagoj on Friday, 30 January 2015.

চ্যালেঞ্জে রাজস্ব আদায় : রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির শঙ্কা

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় জানমাল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে রাজস্ব আদায়ে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ রয়েছে – নজিবুর রহমান, চেয়ারম্যান, এনবিআর

রাজস্ব আদায়ের অভ্যন্তরীণ উৎসগুলোতে চলমান সহিংসতা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আয়কর এখন বড় একটি খাত। এ খাতেও চলমান সহিংসতা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রেও অস্থিতিশীলতা সংকট তৈরি করবে – ড. গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষক, সিপিডি

টুটুল রহমান ও ওবায়দুর রহমান : চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতায় বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগে থেকেই চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির আভাস দেয়া হয়েছিল। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে রাজস্ব সংশ্লিষ্টদের। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সঠিক ভাবে ব্যবসা করতে না পারলে অনেকেই আয়কর দিতে পারবেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মনে করেন, এ বছরের রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব পড়বে আগামী বছরের রাজস্ব আদায়ে। ফলে এবার ঘাটতি না হলেও আগামী বছরে ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছর ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮২০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

রাজস্ব ঘাটতির বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন এনবিআরের নতুন যোগ দেয়া চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। কাজে যোগ দেয়ার প্রথমদিনেই তিনি বলেছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় জানমাল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে রাজস্ব আদায়ে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলছে ২৫ দিন ধরে। ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন ছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ক্ষতি তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। গত ২৮ জানুয়ারি উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এমনকি আইন করে ২০ বছরের জন্য হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, কয়েক দিনের অবরোধ-হরতালে তাদের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। আর এ ক্ষতির কারণে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাজস্ব আদায় কমে যাবে উল্লেখযোগ্য হারে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তাপনিমুখী পোশাকশিল্পে প্রতিদিন ক্রয় আদেশ বাতিল হচ্ছে। সহিংসতার কারণে বিদেশি ক্রেতারা এই মুহ‚র্তে বাংলাদেশে আসছে না। ইতোমধ্যে এ খাতে ৩০ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। হুমকিতে পড়েছে ৪০ লাখের বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এই শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও রাজস্ব আদায়ের অন্যতম খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এককভাবে সব থেকে বেশি রাজস্ব দিয়ে থাকেন সরকারকে। চলমান সহিংসতার কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সংকট সৃষ্টি হয়েছে রপ্তানি বাণিজ্যে। এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে ব্যবসায়ীদের পক্ষে রাজস্ব দেয়া সম্ভব হবে না। খুচরা বাজারেও আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না। ফলে ভ্যাট খাতের মাধ্যমে যে রাজস্ব সরকার পায় সেখানেও ঘাটতি হতে পারে।

এদিকে, রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস দেশের স্থলবন্দরগুলো। কিন্তু টানা অবরোধের কারণে অধিকাংশ সময়ে বন্ধ থাকছে এই বন্দরগুলো। ফলে স্থলবন্ধর থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অনেকে। অবরোধের প্রথম ৯ দিন বন্ধ ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর। পরে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীরা সম্মত হন। তবে ওই ৯ দিনে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। এভাবে অবরোধের মধ্যে ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর প্রায়ই বন্ধ থাকছে। ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাতে হচ্ছে সরকারকে। এভাবে চললে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে এনবিআর।

এর আগে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা করেছিল।

গত বছর ডিসেম্বরে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করেছিল জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। ডিসেম্বরে এক বৈঠকে স্থায়ী কমিটি রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরকে আরো জোরালো ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেয়। ওই সময় এনবিআর জানায়, যে হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, তাতে অর্থবছর শেষে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় সম্ভব নয়। তবে সম্ভব হবে যদি অর্থনীতি স্থিতিশীল ও রাজনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে। ওই বৈঠকে এনবিআর জানায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফা থেকে করের বড় একটি অংশ আসে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের মুনাফা ভালো নয়। স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল উৎস থেকে ভ্যাট আদায় কমে গেছে। এসব কারণে নভেম্বর পর্যন্ত প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় হয়নি। ডিসেম্বরের পর থেকে আদায় বাড়বে বলে সংসদীয় কমিটিকে আশ্বস্ত করে এনবিআর। তবে ডিসেম্বর শেষ না হতেই দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। ফলে বড় ধরনের হুমকিতে পড়েছে রাজস্ব আহরণ।

এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অর্থনীতি গতিশীল থাকলে এবং জিডিপি কাক্সিক্ষত হারে বাড়লে লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি রাজস্ব প্রশাসনকে ডিজিটালাইজড করতে যেসব সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, তার সফল বাস্তবায়ন করতে হবে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আদায়ে চলমান সংকট খুব বেশি প্রভাব ফেলার কথা নয়। কারণ এক বছরের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পরের বছরে রাজস্ব আদায় হয়। ফলে বর্তমানে যে সহিংসতা চলছে তাতে এ বছরের রাজস্ব আহরণে প্রভাব পড়ার কথা নয়। চলতি বছর রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি আদায় করা এনবিআরের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। চলমান সহিংসতার দোহাই দিয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি রেখে হয়তো সমস্যা সমাধান করা যাবে। তবে সেটি সঠিক হবে না।

তিনি বলেন, তবে চলমান সহিংসতার প্রভাব পড়বে আগামী বছর বা তারপরের বছর। কারণ এখন যা চলছে তাতে করে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে। রাজস্ব আদায়ের অন্যতম প্রধান খাত হলো আয়কর। সঠিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা না করা গেলে অবশ্যই আয়কর আদায় কম হবে। তবে সেটি চলতি বছরে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের মূল জায়গা হলো আমদানি-রপ্তানি। সেখানে এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের সমস্যা এখনো তৈরি হয়নি। বরং রপ্তানিতে কিছুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই খাতগুলো থেকে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের বাধা এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে রাজস্ব আদায়ের অভ্যন্তরীণ যে উৎসগুলো রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে চলমান সহিংসতা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আয়কর এখন বড় একটি খাত। এ খাতেও চলমান সহিংসতা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। আসতে পারে শ্লথগতি। ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রেও অস্থিতিশীলতা সংকট তৈরি করবে। ফলে চলমান পরিস্থিতি রাজস্ব আদায়ের অভ্যন্তরীণ খাতগুলোতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।

তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট পেশের পর সিপিডির পক্ষ থেকে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। সে সময়েও আমরা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা ভেবেই সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। তবে চলমান সহিংসতা আরো দীর্ঘ হলে এর থেকেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে অর্থনীতিতে।