Professor Mustafizur Rahman on factors behind soaring interest rate

Published in Jugantor on Wednesday, 15 May 2014. 

সুদের নামে ব্যাংকগুলোর মহাজনী ব্যবসা

দেলোয়ার হুসেন, মিজান চৌধুরী, মনির হোসেন

ঋণের বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত সুদ আদায়ের নামে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ‘মহাজনী ব্যবসা’ করছে। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি মানছে না। হিসাবের মারপ্যাঁচের মাধ্যমেও বাড়তি সুদ আদায় করছে।

শিল্পঋণের সুদের হার ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃত হিসাবে এই হার দাঁড়ায় ১৮ থেকে ২২ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি।

ব্যাংকগুলো সুদ হিসাব পদ্ধতিতে ফাঁকি দিতে তিন মাস পরপর সুদকে মূলধনে রূপান্তর করছে। মূলধনের পাশাপাশি সুদের ওপরও সুদ আরোপ করছে, যা আঞ্চলিক ভাষায় ‘চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আরোপ বা মহাজনী ব্যবসা।’ এছাড়া ব্যাংকগুলো নিয়মিতভাবে ঋণের মূল টাকা থেকে সুদ বা অন্যান্য সার্ভিস চার্জ আদায় করছে। এতে গ্রাহক ঋণের পুরো টাকা হাতে না পেলেও পুরো ঋণের ওপর সুদ দিতে হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সুদের হার আরও বেড়ে যাচ্ছে।

উদ্যোক্তা বলেছেন, এত চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। করলেও তা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। তারা অবিলম্বে সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার জোর দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। শিল্পায়ন হবে না। কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে।

ঋণের সুদের হার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলোতে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এই হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও ‘উপরি’ খরচ বেশি পড়ায় ঋণের ব্যয় বাড়ছে, যা সুদের হার বাড়াচ্ছে।

জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত তিন বছরে বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রতি বছর গড়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগ না হওয়ার একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, সুদের হার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকতে পারবে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এদিক থেকে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ রফতানিকৃত পণ্যের দরদাম ক্রেতা ও বিক্রেতা মিলে ঠিক করেন। তিনি এ সময় ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, ওই দেশে প্রকল্প ব্যয় বেশি ও ঋণের উচ্চ সুদ রয়েছে। এরপরও দেশটি অর্থনীতির দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশীয় শিল্প বাঁচাতে ঋণের সুদ কমাতে হবে। এ ব্যাপারে এফবিসিসিআইর পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের নীতিমালা সহজ করা দরকার।

মাত্রাতিরিক্ত সুদ : সরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ করছে ১৩ থেকে ১৬ শতাংশ সুদে। কৃষিভিত্তিক শিল্পে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ, চলতি মূলধন ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ, গৃহায়ন খাতে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ, বাণিজ্যিক ঋণ দিচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ সুদে। পণ্য রফতানির বিপরীতে পাওয়া নগদ আর্থিক সহায়তা বন্ধক রেখে নেয়া ঋণ দিচ্ছে ১৫ শতাংশ সুদে। বেসিক ব্যাংক কোনো কোনো খাতে ১৮ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন দিচ্ছে। অগ্রণী ব্যাংক ১৬ এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সাড়ে ১৫ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন দিচ্ছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে প্রকল্প ঋণে সুদ নিচ্ছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ। কৃষিভিত্তিক শিল্পে তারা ঋণ দিচ্ছে ১১ থেকে ১৩ শতাংশে। এই খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদের হার কম হলেও ঋণ বিতরণের পরিমাণ খুবই কম। ক্ষুদ্র শিল্পে মেয়াদি ঋণ দিচ্ছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে। চলতি মূলধনের জোগান দিচ্ছে ১৩ থেকে ১৭ শতাংশে। উত্তরা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ সুদে এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক সাড়ে ১৬ শতাংশে চলতি মূলধন দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়ে কম সুদেও তারা ওই ঋণ দিচ্ছে।

বাণিজ্যিক ঋণ বেসিক ব্যাংক ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ, অন্যান্য সরকারি ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ সুদে। বেসিক ব্যাংক গৃহায়ন খাতে ঋণ দিচ্ছে ১৭ থেকে ১৯ শতাংশে। কমার্স ব্যাংক এই খাতে ঋণ দিচ্ছে সাড়ে ১৭ থেকে সাড়ে ১৯ শতাংশ হারে। উত্তরা ব্যাংক দিচ্ছে ১৮ শতাংশে। অন্যান্য ব্যাংকগুলো ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সুদ জোর করে কমানো যায় না। আমানতকারীদের সুদ দেয়া, খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন রাখাসহ বিভিন্ন খরচ মিলে ব্যাংকগুলো সুদ হার নির্ধারণ করে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমছে। এতে ঋণের সুদও কমবে। তিনি আরও বলেন, রফতানি খাতে ৭ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৩ শতাংশ, কিছু নিত্যপণ্য উৎপাদনে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। যারা উৎপাদনমুখী তারা কম সুদে ঋণ পাচ্ছে। তবে অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের সুদ একটু বেশি। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদের হারের মধ্যকার ব্যবধান) যেন ৫ শতাংশের নিচে থাকে। কস্ট অব ফান্ড কমাতে ব্যাংকগুলোকে কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছি। কস্ট অব ফান্ড কমলে ঋণের সুদের হার কমবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনিটরিং করছে।

ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫ শতাংশের কম সুদে বিদেশী ঋণ নেয়ার রাস্তা খুলে দিয়েছে। যেসব শিল্প মালিকের রেটিং ভালো এমন অনেক কোম্পানি এই সুযোগ নিয়ে বিদেশী ঋণ নিয়েছে। গত বছর প্রায় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশী ঋণ গ্রহণ করেছে শিল্প মালিকরা। এটির কারণেও ঋণের সুদের হার নিচের দিকে টানবে। কারণ ব্যাংকে অলস টাকা বসিয়ে রাখলে লোকসান হবে, লাভ হবে না। ফলে ব্যাংক ধীরে ধীরে সুদের হার কমাতে বাধ্য হবে। কারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে ৮ শতাংশে আমানত গ্রহণ করে ব্যাংকে টাকা বসিয়ে রাখলে তাদের লোকসান হবে। তবে এটি বাস্তবায়নে একটু সময় লাগবে। এটিই অর্থনীতির নিয়ম। গভর্নর আরও বলেন, অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী হলে ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে হলেও বিনিয়োগে যাবে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলো মাত্রাতিরিক্ত সুদ নিচ্ছে। এই সুদে ঋণ নিয়ে কারও পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো যে হারে সুদ নিচ্ছে, তাতে আসল ঋণ পরিশোধ দূরে থাকুক, সুদ পরিশোধই সম্ভব নয়। এতে ব্যবসায়ীরা এমনিতেই খেলাপি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছে, সারা দেশে এ ধরনের ১০ জন ব্যবসায়ীও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এটা সম্ভব নয়। এই ব্যাংক উদ্যোক্তার মতে, ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হওয়া উচিত ৭ থেকে ৮ শতাংশ। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক মালিকদের পক্ষ থেকে কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার আগে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাতে হবে। এরপর বেসরকারি ব্যাংকের জন্য সুদের নীতিমালা করে দিতে হবে।

রফতানি ঋণে শুভঙ্করের ফাঁকি : সরকার রফতানি খাতকে উৎসাহিত করতে ঋণের সুদের হার বেঁধে দিয়েছে। এ খাতে সুদের হার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো আরও ১ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ নিতে পারে। এই মিলে ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার হওয়া উচিত ৮ শতাংশ। বাস্তবে কাগজে-কলমে রফতানি ঋণের সুদের হার ৮ শতাংশের সঙ্গে অন্যান্য ফি ও কমিশন যোগ করে আরও বেশি পড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এই ঋণের বিপরীতে অন্য কোন ফি বা কমিশন নেয়ার কথা নয়। এছাড়া ব্যাংকগুলো নানা কৌশলে রফতানি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে বিভিন্ন নামে অন্য খাতে নিতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করছে। যেগুলোর সুদের হার বেশি। যে জন্য ব্যাংকগুলো রফতানি বাণিজ্যে অর্থায়ন নামে ঋণ প্রকল্প চালু করেছে। যার সুদের হার ১৩ থেকে ১৬ শতাংশ। বাড়তি ঝামেলা এড়াতে উদ্যোক্তারাও কম সুদে রফতানি ঋণের দিকে বেশি না ঝুঁকে বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

রফতানি খাতকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে দুটি তহবিল রয়েছে। এর একটি হচ্ছে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। যা থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়। ব্যাংকগুলো এই তহবিল থেকে ঋণ দিলে পরে বাংলাদেশ ব্যাংক তা ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করে দেয়। আরেকটি রয়েছে রফতানি ঋণ তহবিল, যা থেকে উদ্যোক্তা ঋণ নিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। ব্যাংকাররাও এ তহবিলটি ব্যবহার করতে চায় না নানা ধরনের নিয়মের বেড়াজালের কারণে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই, যে বাংলাদেশে ঋণের যে সুদ তা নিয়ে ব্যবসা করা অত্যন্ত কঠিন। তবে ব্যাংকগুলো দুটি কারণে সুদের হার কমাতে পারছে না। তিনি বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ। এ হিসাবে আমানতের সুদের তার চেয়ে বেশি হতে হবে। আর আমানতে সুদের হার না কমলে ঋণের সুদ কমানো সম্ভব নয়। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের অনেক কু-ঋণ রয়েছে। এই সুদ ভালো ঋণের ওপর থেকে সমন্বয় করতে হয়। তিনি বলেন, সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর নজরদারির মাধ্যমে ব্যাংক কু-ঋণ কমিয়ে আনতে হবে।

ঋণের হিসাবে মারপ্যাঁচ : বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ রয়েছে সরল হারে অর্থাৎ ঋণের মূল টাকার ওপর বছর হিসাবে সুদ আরোপ করার জন্য। কিন্তু ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে এ নির্দেশ মানছে না। তারা হিসাবের ফাঁকি-ঝুঁকির মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে চক্রবৃদ্ধি হারে বা সুদের ওপর সুদ আরোপ করছে। এতে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ঋণ আর পরিশোধ হয় না। সুদ ও মূল টাকার অংক বাড়তেই থাকে। একটা সময় গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো সুদ কমাতে থাকে। কিন্তু তারা যে অতিরিক্ত সুদ আরোপ করেছে সে বিষয়টি গ্রাহকের নজরে আসে না।

বর্তমানে ব্যাংকগুলো প্রায় সব ধরনের ঋণের বিপরীতে তিন মাস পর পর সুদ হিসাব করে তা গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করছে। গ্রাহক না দিলে সুদের অর্থ মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করছে। এতে মূল ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে প্রতি তিন মাস পর পর ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ করায় সুদের ওপর সুদ আরোপিত হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এভাবে সুদ আরোপের কারণে ১৫ শতাংশ সুদের হার ঋণে ব্যাংক আদায় করছে ১৮ শতাংশ। এর সঙ্গে কোনো কোনো ব্যাংক ঝুঁকি কমিশন আদায় করছে। ব্র্যাক ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ এসএমই খাতে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। তারা ঋণ প্রক্রিয়াকরণে ১ থেকে ২ শতাংশ হারে কমিশন আদায় করছে। যা ঋণের সুদকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংকও ঋণ প্রক্রিয়াকরণে বাড়তি ফি আদায় করছে।

কোনো কোনো ব্যাংক ঋণের মূল টাকা আদায় না করে বেশি জোর দেয় সুদ আদায়ে। এমনকি গ্রাহকের ঋণ অ্যাকাউন্ট থেকে সুদের টাকা সমন্বয় করার নজিরও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে এ ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। গ্রাহক মূল ঋণ শোধ করলেও ব্যাংক তা সমন্বয় করে সুদের সঙ্গে। এছাড়া ঋণের টাকা অ্যাকাউন্টে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে ব্যাংকের বিভিন্ন কমিশন ও সার্ভিস চার্জ কেটে রাখে। ফলে গ্রাহক ঋণের পুরো টাকা পায় না। এতে সুদের হার আরও বেড়ে যায়।

এভাবে সুদের হার বেড়ে বছর শেষে তা সরকারি ব্যাংকগুলোতে গড়ে ১৮ থেকে ২১ শতাংশে দাঁড়াচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এই সুদের হার আরও বেশি। এদের সুদের হার বেড়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশে দাঁড়াচ্ছে।

সুদের হারের এই ধরনের হিসাব পদ্ধতির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালার আওতায় তিন মাস পর পর ঋণ শ্রেণীকরণ, প্রভিশনিং, স্থগিত সুদ, আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করতে বাধ্য করায় ব্যাংকগুলোও তা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী সুদ আদায় করতে না পারলে তা আয় খাতে নেয়া যায় না। আর তা নিতে না পারলে আয় বাড়ে না। ফলে ব্যাংকারদের পর্ষদ থেকে চাপে থাকতে হয়। এ কারণে তারা যেভাবেই হোক সুদ আদায়ের দিকে নজর রাখে বেশি। এতে গড়ে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য পুঁজি প্রাপ্তির বিষয়টি সহজ করতে হবে। এটি মুদ্রাবাজারও হতে পারে, আবার পুঁজিবাজারও হতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ঋণের সদু চড়া। ফলে ঋণের সুদ না কমালে উদ্যোক্তারা ব্যাংকে যেতে চাইবে না। এতে ব্যাংক ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মতে, ভালো কোম্পানিগুলো চাইলে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে।

তিনি বলেন, ঋণের সুদের হারের হিসাবের স্বচ্ছতা থাকা উচিত।

প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সুদের হার বেশি : প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সুদের হার বেশি। ব্যাংকগুলো যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তেমনি পদ্ধতিগত জটিলতায়ও সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে গড় ৯ শতাংশ। ভারি শিল্প স্থাপন করলে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। নিয়মিত ঋণ শোধ করলে সুদের ওপর বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। এতে করে নিট সুদের হার কমে যাচ্ছে।

শ্রীলংকায় পরিবেশবান্ধব ও উৎপাদনমুখী খাতে শিল্প ঋণের সুদের বাংলাদেশী টাকায় ৮ থেকে ১২ শতাংশ। পাকিস্তানে ওই সব খাতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ। এসব দেশে নিয়মিত ঋণ শোধ করলে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। রফতানিমুখী শিল্প স্থাপন করলে এ হার আরও কম।

বাংলাদেশে রফতানি ঋণের সুদের হার ৭ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপিত রয়েছে। এর বাইরে ঋণ ছাড় করতে দিতে হচ্ছে নানা ধরনের ফি।

লিবিয়ায় শিল্প স্থাপন করলে কোনো রকম সুদ ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়। সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওই ঋণের জোগান দেয়া হয়।

ব্যাংকারদের সংগঠন এবিবির সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিন বলেন, বাংলাদেশে ঋণের সুদের হার বেশি। আমরা স্বীকার করছি এই হারে সুদ দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন। কিন্তু একটি বিষয় ভাবতে হবে ব্যাংকও একটি ব্যবসা। তার মতে, ঋণের সুদ কমাতে হলে আগে আমানতের সুদ কমাতে হবে। পাশাপাশি প্রভিশন এবং খেলাপি ঋণ কমাতে হবে।

মূল্যস্ফীতি প্রভাবিত করছে সুদ হারকে : গত ১০ বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হার ওঠানামা করছে। কখনও স্থির হয়নি। ওই সময়ে এই হার সর্বোচ্চ ১১ থেকে সর্বনিু আড়াই শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। মূল্যস্ফীতির হারের এই ওঠানামা সুদ হারকেও প্রভাবিত করেছে। ঋণ গ্রহণের পর মূল্যস্ফীতির হার কমে গেলে ঋণ গ্রহীতার প্রকৃত সুদের হার বেড়ে যায়। আবার বেড়ে গেলে প্রকৃত সুদের হার কমে যায়। উদ্যোক্তা বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করলে এবং ওই দেশে যদি মূল্যস্ফীতি বেশি হয় তাহলেও উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব বিবেচনায় মূল্যস্ফীতির হার ঋণের সুদের হারকে প্রভাবিত করে।

এছাড়া আমানতকারীরা চায় মূল্যস্ফীতি কম থাকুক। মূল্যস্ফীতি কম থাকলে তারা ব্যাংকে টাকা রেখে মুনাফা ঘরে নিতে পারে। এ হার বেশি হলে আমানতকারীদের টাকা ক্ষয়ে যায়। এ কারণে তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। তখন উদ্যোক্তার পণ্যের চাহিদা কমে যায়।

কেন সুদ বাড়ে : বাংলাদেশে ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক হলেও বাস্তবে তা চাপিয়ে দেয়া। বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সুদের হার নির্ধারিত হয় না। যে কারণে সুদের হার অর্থনীতির নিয়ম মেনে বাড়ে বা কমে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। এটাকে ইনফ্রেশনারি টেক্স ধরা হয়। দেশের অর্থনীতিতে এখন এই টেক্সের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

এছাড়া ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এ কারণে তাদের প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতেও সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার চড়া। বিনিয়োগের জন্য এ হার কমাতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে সুদের হার কমানো একমাত্র উপাদান নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ অনেকগুলো বিষয় জড়িত। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। ফলে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ঘুষসহ ১০ কারণে বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ব্যয় : ঘুষ প্রদান, অতিরিক্ত সুদ ও সার্ভিস চার্জ আরোপসহ ১০ কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চালানো এক জরিপে এ কারণগুলো বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই জরিপে বলা হয়, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। ঋণ পেতে ঘুষ প্রদান করতে হয়। এছাড়া ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত সুদ বা সার্ভিস চার্জ আরোপ করছে। ঋণের ক্ষেত্রে জামানতের মূল্যায়ন ফি আদায় করছে। পাশাপাশি জামানবিহীন ঋণ স্বল্পতা রয়েছে। কারণগুলোতে আরও বলা হয়, অর্থাভাবে উৎপাদন সক্ষমতার সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। প্রচণ্ডভাবে রয়েছে অবাকাঠামো, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ব্যয় বাড়ছে জরিপের বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতি ও বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে। পোশাক খাতে নতুন মজুরি ঘোষণা করায় এ ব্যয় আরও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে বিদেশী প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এ জন্য ২০১৩ সালে নতুন কোনো দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারী আসেনি।

ব্যাংকের উচ্চ সুদ ও শিল্প করার ক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুৎ দিতে পারছে না সরকার। সে কারণে নতুন বিনিয়োগ আসেনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। ওই প্যাকেজের আকর্ষণে বাধ্য হয়ে বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসবেন।