Professor Mustafizur Rahman on private investment, energy crises and infrastructure

Published in The Daily Ittefaq on Wednesday, 21 May 2014.

সাত বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ সর্বনিম্নে!
সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে না

আহসান হাবীব রাসেল

কয়েক বছর ধরে দেশে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। গত সাত বছরের মধ্যে জিডিপিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অবদান সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার কথা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অপচয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঠিক প্রতিফলন বেসরকারি বিনিয়োগে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া অবকাঠামোগত ও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট কাটেনি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বন্ধ হলেও রয়ে গেছে দুশ্চিন্তা। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আবার বিনিয়োগ না বাড়ায় বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। এসব কারণে সরকারের নীতি নির্ধারকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। অর্থমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার বেসরকারি বিনিয়োগ খরা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে উন্নয়ন ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন নীতি নির্ধারকরা। গেল ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে এডিপির মাধ্যমে সরকার মোট বিনিয়োগ করেছিল ২৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। অর্থাত্ ৫ বছরের মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়ায় মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) আনুপাতিক হারে সরকারি বিনিয়োগের অংশ বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগের হার জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল, ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ চিত্র হতাশাজনক। গত সাত বছরের মধ্যে বর্তমানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অবদান সর্বনিম্ন। ২০১২-১৩ অর্থবছরের হিসাবে বাংলাদেশে এখন বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপি’র ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর আগে এর চেয়ে কম বিনিয়োগ ছিল ২০০৫-০৬ অর্থবছরে, তখন এ হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে এ হার ১৯ শতাংশে উঠে আসে। এরপর থেকে বেসরকারি বিনিয়োগের অবদান ১৯ শতাংশের ঘরে স্থির ছিল। তবে ২০১১-১২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অবদান বেড়ে জিডিপির ২০ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর ফের কমতে থাকে বেসরকারি বিনিয়োগের অবদান। গেল অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে কমে ১৯ শতাংশের নীচে নেমে আসে। চলতি অর্থবছরেও বেসরকারি বিনিয়োগের নিম্নমুখী ধারা রয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার বিনিয়োগ বাড়ালে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ। এছাড়া দেশে অর্থের সরবরাহ বাড়ে, বাড়ে মানুষের আয় ও সঞ্চয়। ফলে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু অর্থনীতির নিয়মের ব্যতয় ঘটছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত কয়েক বছর ধরে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না।

এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের বিনিয়োগ ব্যয় বাড়লেও অবকাঠামো উন্নয়নে তা তুলনামূলক কম অবদান রাখছে। কারণ উন্নয়ন ব্যয়ে অপচয় বেশি হচ্ছে। তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের মধ্যে বিদ্যুত্ সরবরাহের খরচ ১৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুত্ ছাড়া অন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে (মূল্যস্ফীতির বাইরে) বাড়ছে। ফলে সরকারি ব্যয় যে হারে বাড়ছে সে হারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না। এতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উত্সাহ পাচ্ছেন না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের বিনিয়োগ বেসরকারি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করে, এটাই নিয়ম। তবে গত কয়েক বছরে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও গ্যাসের সঙ্কট রয়ে গেছে, রাস্তা-ঘাটের সমস্যা রয়ে গেছে। বিদ্যুতের উত্পাদন বেড়েছে, তবে কুইক রেন্টালের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় বিদ্যুতের খরচ বেড়েছে। এজন্য বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষিত হয়নি। তাছাড়া দীর্ঘ মেয়াদী ও মধ্যম মেয়াদী বিনিয়োগের জন্য যে রাজনৈতিক পরিবেশ কাম্য সেটি নেই। নিষ্কণ্টক জমির অভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিকল্পিত বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ব্যবহারযোগ্য করতে পারলে বেসরকারি বিনিয়োগের আকর্ষণ বাড়তো। কিন্তু তা হয়নি। এদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিতভাবে না বাড়ায় ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য জমে আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঞ্চিত অর্থ বিদেশে পাচারও হয়ে যাচ্ছে।

সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বিনিয়োগের গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ। বিনিয়োগ অর্থের সদ্ব্যবহার হয়নি। টাকার অঙ্কে সরকারের বিনিয়োগ বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি। তিনি আরও বলেন, সরকার বিদ্যুত্ উত্পাদনের সক্ষমতা বাড়িয়েছে, কিন্তু বিদ্যুত্ সঞ্চালন সে রকম বাড়েনি। ফলে সরকারি ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়েনি।

এদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি থেকেও। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১১ দশমিক ৮ ও ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৮৩ ও ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ ছিল। তাছাড়া প্রায় এক বছর ধরে বিনিয়োগের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে জমা হচ্ছে অলস টাকার পাহাড়।

শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো জমি ও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট। সরকার জমির সমস্যা দূর করতে অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টির পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। গ্যাস-বিদ্যুত্ পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের ব্যয় বাড়লেও এ সঙ্কট রয়ে গেছে। সরকার বিদ্যুত্ সঙ্কট সমাধানে কুইক রেন্টালের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে খরচ বাড়লেও বিদ্যুতের সুফল পাওয়া যাচ্ছে কম। তাই স্থায়ী বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের উপর জোর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।