Professor Mustafizur Rahman on promoting regional trade

Published in Arthoniti Protidin on Thursday, 19 June 2014.

৯৪ দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য

আলতাফ হোসেন

দশ মাসে ঘাটতি ৪৬ হাজার কোটি টাকা বৈষম্য কমাতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে : বাণিজ্যমন্ত্রী
আমদানি শিল্প বিকাশে ভূমিকা রাখছে না : বিআইডিএস
আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে হবে : সিপিডি

বিশ্বের ১৯০ দেশে পণ্য রফতানি করছে বাংলাদেশ। পণ্য আমদানি করা হচ্ছে ১৬৫ দেশ থেকে। আর আমদানি বাণিজ্য নেই ২৫ দেশের সঙ্গে। রফতানি বাণিজ্যে ৬০ দেশের অংশীদারিত্ব অতি নগণ্য। অপর দিকে বাণিজ্য বৈষম্য রয়েছে ৯৪ দেশের সঙ্গে।

বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পৃথক পৃথক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। তুলনামূলক রফতানি আয় বাড়লেও খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যয়ই বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির অন্যমতম কারণ বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবেই ৫৮৯ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকব্যবস্থায় গতকাল বুধবারের ডলারের দর অনুযায়ী আলোচ্য সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ৪৫ হাজার ৭৫৫ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার টাকা।

একক দেশ হিসেবে সব চেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি চীনের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। অপর দিকে বাণিজ্যে উদ্বৃত্তের তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। সে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে বাণিজ্য করছে বাংলাদেশ।

তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, আগের অর্থবছরের (২০১২-১৩) ৯৪টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য থাকলেও তা কমিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। মন্ত্রী জানান, ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঘাত হানতে পারেনি। বরং বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীতের তুলনায় সুদৃঢ় হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শুরুর দিকে আমদানি কম আর রফতানি আয়  বেশি ছিল। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কম ছিল। বছরের শেষ দিকে এসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। সে কারণেই বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি।

অবশ্য বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষের হিসাবে ঘাটতি বাণিজ্য ৭০১ কোটি ডলার বা ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বৈধ বাণিজ্যের     পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিমুখী অবৈধ বাণিজ্য রয়েছে। তার সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করা গেলে ঘটতি বাণিজ্যের অঙ্কে বড় ধরনের পরিবর্তন দৃশ্যমান হতো।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাস (জুলাই থেকে মার্চ) সময়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে, যার পরিমাণ ৫১১ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ডলার। এ সময়ে মোট আমদানির পরিমাণ ৫৬৬ কোটি আট লাখ ডলার। এর বিপরীতে রফতানি হয়েছে মাত্র ৫৪ কোটি ৬৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ পাঁচ হাজার ডলার। বাংলাদেশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘাটতির তালিকায় থাকা অপর দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কানাডা প্রভৃতি। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১৭ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।

একই সময়ে দেশটি থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যয় করা হয়েছে ৪৪৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। এর বিপরীতে ভারতে পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ২৮ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার। ঘাটতিতে শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর ১৭৩ কোটি ৪৪ লাখ, মালয়েশিয়া ১৪৪ কোটি ৬৯ লাখ ও কোরিয়া ৬৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।

বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকা দেশগুলোর তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পরই রয়েছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্যান্স, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি। এর মধ্যে জার্মানির সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে ৩১২ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার। দেশটি থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৪১ কোটি ২৩ লাখ ডলার। বিপরীতে রফতানিতে আয় হয়েছে ৩৫৩ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ ছাড়া বাণিজ্য উদ্বৃত্তিতে শীর্ষ থাকা অন্যান্য দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য ১৮২ কোটি দুই লাখ, ফ্রান্স ১০৭ কোটি ৫৫ লাখ, স্পেন ১০৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের নয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৪৯৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়েছে। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ ৫৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি খাতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট তিন হাজার ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। আর পণ্য রফতানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় হয়েছে দুই হাজার ৪৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই হিসাবে ১০ মাসে ঘাটতি হয়েছে ৫৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার ৭৩৩ কোটি ডলারের। একই সময়ে পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল দুই হাজার ১৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার।

রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতি বছরই বাণিজ্য ঘাটতি হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ঘাটতি ছিল ২০১১-১২ অর্থবছরে। এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩২ কোটি ডলার। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭০১ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ জানায়, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে টেক্সটাইল অ্যান্ড আর্টিকেল থেরিয়ফ খাতে আমদানি হয়েছে ৩০২ কোটি ১৯ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২৭০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। এ খাতে গত বছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

তবে খাদ্য আমদানি খাতে ১১৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে খাদ্য আমদানি হয়েছে ১২৭ কোটি এক লাখ ডলার। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ খাতে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার।

এ ছাড়াও গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ভোজ্য তেল ২৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ, মূলধনি যন্ত্রপাতি ২৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, কাঁচা তুলা ও সুতা ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ আমদানি বেড়েছে।

গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত দিয়ে অর্থবছর শুরু হয়। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সে ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের উদ্বৃত্তের পরিমাণ কমছে।

আমদানিসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ২০ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

ফলে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে উদ্বৃত্ত কমে ১৩৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে উদ্বৃত্ত ছিল ২১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

অর্থনীতির বিশ্লেষক জায়েদ বখত বলেন, যেসব পণ্য ও দ্রব্যের আমদানি বাড়ছে সেটা দেশে বিনিয়োগ বা শিল্প বিকাশের জন্য খুব বেশি অবদান রাখছে না। চাল ও গম আমদানি বাড়ার কারণেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি যেটা বেড়েছে, সেটা টেলিকম খাতের থ্রিজি মেশিনারি আমদানির কারণে বেড়েছে। দেশে বর্তমানে যে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, তা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে এবং বিনিয়োগও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করে মোট বহির্বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ। নাফটা, আসিয়ানসহ কোনো শুল্পমুক্ত বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৩০ শতাংশের নিচে নয়। তবে সার্ক অঞ্চলে আন্তবাণিজ্য মাত্র ৫ শতাংশ। আঞ্চলিক উন্নয়নে তা অবশ্যই বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, তৈরি পোশাকই মূলত বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের মধ্যে অন্যতম। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে তৈরি পোশাকের গুরুত্ব রয়েছে। তবে অবকাঠামো খাত উন্নয়ন হলে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়বে। এজন্য সব দেশের আন্তরিকতা থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. শাহজাহান খান বলেন, সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য একরকম হবে ন। যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হচ্ছে সেসব দেশে পণ্য রফতানি বাড়ানোর জন্য গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ মধ্যে চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। চীন যদি এ দেশে তাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলো রিলোকেট করে তাহলে রফতানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না, তাই মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি কম। খাদ্যসহ অন্যান্য দ্রব্য বেশি পরিমাণে আমদানির কারণেই গত দুই মাস ধরে সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি বেশি পরিমাণে বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন।