CPD study on FY2015 GDP growth cited

Published in Prothom Alo on Tuesday, 3 June 2014.

হরতাল-অবরোধে অর্থনীতি চাঙা, বেড়েছে জিডিপি!

জাহাঙ্গীর শাহ

টানা ছয় মাসের রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ, হরতাল ও অবরোধে আপনি যে ১০ টাকার রিকশা ভাড়া ৩০ টাকা দিলেন, যে পর্যটক হোটেলে বন্দী থাকায় বাড়তি রুম ভাড়া গুনলেন, যে ব্যবসায়ী পাঁচ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বিপুল আর্থিক ক্ষতি মানলেন—তাঁরা কিন্তু অর্থনীতিকে উপকারই করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ঠিক এসব কারণেই সেবা খাতে লেনদেন অনেক বেড়েছে। আর তাতেই মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে। আবার ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হওয়ার তথ্যও অর্থনীতিতে নেই।

চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে সাময়িক হিসাব করেছে বিবিএস। তাদের হিসাবে, শিল্পোৎপাদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিসম্পদের উৎপাদন এবং সরবরাহ—এই দুটি খাত ছাড়া বাকি ১৩টি খাতে গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। জিডিপি গণনার ১৫টি খাত নির্ধারিত রয়েছে।

দেখা গেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন বা সেবা সৃষ্টি হয়, আর্থিক মূল্যে এর ৫৪ শতাংশই আসে সেবা খাত থেকে। এবারের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে মূলত এই সেবা খাতের কারণেই। তবে এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে প্রবৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। অর্থনীতি-বিদেরাও প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে সন্দিহান।

বাজেট ঘোষণার সময় চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পূর্বাভাস ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন মহলের অব্যাহত সমালোচনার পর বিবিএস একটি ব্যাখ্যা তৈরি করেছে। পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি এই সংস্থাটি ব্যাখ্যায় বলেছে হরতাল-অবরোধে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। যানবাহনের অভাবে মানুষ রিকশা-ভ্যানে বেশি ভাড়া গুনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছে। আবার পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাক ভাড়া বেশি দিতে হয়েছে, যা সেবা খাতের বাড়তি মূল্য সংযোজন করেছে। এমনকি অবরোধে পর্যটকেরা হোটেলবন্দী ছিলেন, সেটাও বাড়তি সেবা হিসেবে মনে করছে বিবিএস।

বিবিএসের ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পরিচালক জায়েদ বখত। তিনি বলেন, সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই৷ তবে ২০১২-১৩-এর চেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি বেশি হলো কীভাবে, এটাই প্রশ্ন।

জায়েদ বখত বলেন, পরিবহন, খুচরা ও পাইকারি বেচাকেনা এবং নির্মাণ কাজেই সিংহভাগ সেবা সৃষ্টি হয়। বিবিএস বলছে, কৃষি ও শিল্পপণ্য চলাচলের কারণে সেবা খাতের ওপর পড়ছে। কিন্তু সেই পণ্য কীভাবে চলাচল করল? হরতাল-অবরোধে তো বাস, ট্রাক চলাচল প্রায় বন্ধই ছিল। আবার বিবিএস বলছে, হরতাল-অবরোধে রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান চলাচল বেড়েছে, যা সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। কিন্তু পরিবহন খাতে মোট মূল্য সংযোজনে রিকশা, অটোরিকশা ও ভ্যান চলাচলের অংশীদারত্ব খুবই নগণ্য। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ার পেছনে বিবিএস যেসব কারণ দেখিয়েছে, এর মধ্যে একটি কারণও নেই, যা নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করেছে।

প্রশ্নবিদ্ধ সেবা খাত: বিবিএসের হিসাবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভাঙচুর, অবরোধ সত্ত্বেও সেবা খাত চলতি অর্থবছরে স্থির মূল্যে ২২ হাজার ১১৪ কোটি টাকার বেশি সেবা সৃষ্টি হয়েছে। এর মানে হলো আগের বছরের চেয়ে সমপরিমাণ অর্থের বেশি সেবা নিয়েছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। প্রবৃদ্ধিও হয়েছে আগের চেয়ে দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

সেবা খাতের অন্যতম বড় উপখাত সড়ক ও রেল পরিবহন সেবা। হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক ও রেল পরিবহন। কিন্তু বিবিএসের হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে এই খাতে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি পরিবহন সেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। গত অর্থবছরে যেখানে ৫১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার পরিবহন সেবা দেওয়া হয়েছে, চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

রাজনৈতিক অস্থিরতায় হোটেল, রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ধস নেমেছিল। কিন্তু বিবিএস বলছে, হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় চলতি অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকার বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। এই খাত থেকে এই সেবার আর্থিক মূল্য পাঁচ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় উৎপাদন ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ১৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে সেবা খাতে। সেবা খাতে প্রায় সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

তার পরও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিবিএসের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএস শুধু টাকার অঙ্কে সেবা খাতে কী পরিমাণ মূল্য সংযোজন হয়েছে বা হতে পারে, সেটা ধরেই এ খাতের প্রবৃদ্ধি হিসাব করে। মাঠপর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই সেবা সৃষ্টির আর্থিক পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরিবহন খাতের সেবার মূল্য বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

বিবিএস আরও বলছে, সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া মহার্ঘ ভাতার অধিকাংশই সেবা খাতে খরচ হয়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধনকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ফলে শিক্ষার মতো সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হরতাল-অবরোধে সেবা খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের সেবা নেওয়ার সুযোগও সীমিত ছিল। আবার ভোক্তা চাহিদা যে কমেছে এর বড় প্রমাণ হলো, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায় কমেছে। প্রবাসী-আয়ের একটা বড় অংশই ভোক্তার চাহিদা মেটাতে খরচ হয়। এ বছর প্রবাসী-আয়েও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। তিনি মনে করেন, বেসরকারি বিনিয়োগের বড় অংশই যায় সেবা খাতে। আর আস্থার অভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি।

প্রবৃদ্ধি দেখানোর রাজনৈতিক অভিলাষ: প্রতিবছরই সাময়িক হিসাব করার সময় প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানোর রাজনৈতিক অভিলাষ প্রতিটি সরকারের আমলেই দেখা গেছে। বাজেট ঘোষণার সময় বিদায়ী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি একটু বাড়িয়ে দেখানো হয়। পরে বছর শেষে সেই হিসাব চূড়ান্ত করার পর দেখা যায়, সাময়িক হিসাব থেকে তা কমে গেছে। এমনকি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ থাকে বলে বহুলভাবে অভিযোগ রয়েছে। বিবিএস জিডিপির হিসাব চূড়ান্ত করলেও তা অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হয়।

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে সাময়িক হিসাব করেছিল বিবিএস। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিবিএস চূড়ান্ত হিসাব করে দেখেছে, ওই বছর ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। পরে উচ্চপর্যায়ের আপত্তিতে পড়ে তা পরিবর্তন করে গত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এটা সাময়িক হিসাবের চেয়ে কম।

বিনিয়োগ: বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে স্থিতিশীল অবস্থা থাকলে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সব সময়েই সম্ভব। তবে ৭ শতাংশে উন্নীত করতে হলে অন্যতম শর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে।

দেশের বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা। অথচ বিবিএসের চলতি মূল্যের হিসাবে গত বছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ৪৭ হাজার কোটি টাকা বেশি সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে। আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ গত অর্থবছরের চেয়ে বাড়লেও এর আগের তিন অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। চলতি অর্থবছরে চলতি মূল্যে মোট তিন লাখ ৮৭ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, যা মোট জিডিপির ২৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ।