রোহিঙ্গা সংকট এবং জিলাপির প্যাঁচে জড়ানো মানবতা

সাজ্জাদ মাহমুদ শুভ

ডায়লগ এসোসিয়েট, সংলাপ ও যোগাযোগ, সিপিডি

আমার মনে আছে, ২০১৭-এর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর জুড়ে ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, সদরঘাটসহ বিভিন্ন বাজার-হাটে সহমর্মী মানুষ টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে পড়েছিল। পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করে, বিভিন্ন অফিসের সহকর্মীরা দলগতভাবে চাঁদা তুলেছিল। উদ্দেশ্য একটাই, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নিপীড়িত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান। শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও বাংলাদেশী জনগণ এই সহায়তা প্রদান করেছে। তখন হয়তো সকলের মাঝেই মানবতাবোধ কাজ করেছে, কিন্তু বেশি কাজ করেছে তাৎক্ষণিক সহমর্মিতা। ক্রমাগত সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীরের বিপন্ন মানবতার খবর শুনতে শুনতে বাড়ির কাছে তেমনই ঘটনা সকলকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু, এই তাৎক্ষণিক সহমর্মিতার ব্যাপারটা খুব বেশীদিন স্থায়ী ছিল  না। নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট গবেষকগন যা হয়তো শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন, সাধারণ জনগণ সেটা একটু দেরীতে বুঝেছে। দেশের অন্যান্য জেলার ব্যাপারে জোর দিয়ে বলতে না পারলেও, ঢাকার চিত্র গত ডিসেম্বর থেকে খুব দ্রুতই পাল্টে গিয়েছে। স্বজনহারা রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য যেই বাজারের মানুষ উতলা হয়ে উঠেছিল, সেই বাজারেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটা গালিতে পরিণত হয়েছে। এক রিক্সাওয়ালা আরেক রিক্সাওয়ালাকে, এক মাছওয়ালা আরেক মাছওয়ালাকে, এক বাসের হেল্পার আরেক বাসের হেল্পারকে দেদারসে “ঐ রোহিঙ্গা, তোরে….” বলে গালি দিয়ে চলেছে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এই উদাহরণগুলো, একটি নির্দিষ্ট আয়-সীমার শ্রেণীতে থাকা মানুষদের কথা বলছে। শুরুর দিকে রোহিঙ্গা সংকটে এরাও সহমর্মী ছিল, কিন্তু, দিন গড়াতেই প্রচন্ড প্রতিযোগিতার এই বাজারে তারা নিজেদের পেশা ও রোজগার নিয়ে শংকিত হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা টিকে থাকার তাগিদে স্বল্পমূল্যে শ্রমবাজারে চলে আসবে এই আশংকায় তাদের সহমর্মিতা পরিণত হয়েছে বিদ্বেষে।

আর এখন, সাধারণ জনগণ থেকে দেশের নীতিনির্ধারণী মহল সকলেই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশীদের মানবতাবোধের পেছনে মিয়ানমারের জুড়ে দেওয়া জিলাপির প্যাঁচ আমাদের সবার কপালেই ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা পদক্ষেপের পরও যেখানে এখনও বন্যায় দেশে কোটি কোটি টাকার ফসল-রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে, প্রচন্ড শীতে মানুষ-গবাদিপশু মারা যাচ্ছে, কোটি কোটি যুবক বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তা বিধানের ভার বাংলাদেশের শরীরে এক টিউমার। এই টিউমার যেমন আমাদের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে, তেমনি সঠিক চিকিৎসা না করাতে পারলে ক্যান্সারের ভয়টাও দেখাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সংকটের ফলে বাংলাদেশ যেমন ভূ-রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে, তেমনি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। দেশের এক বেসরকারি গবেষণার অনুমান বলছে, যদি প্রতিদিন ৩০০ জন করেও রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়, তাহলেও পুরো প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ১২ বছর সময় লাগবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এই অনুমান মিথ্যা হোক। কিন্তু যদি ১২ বছরের জায়গায় ৬ বছরও লেগে যায়, সেই পরিস্থিতি আমরা কতটা আঁচ করতে পারছি? এই দীর্ঘসময়ে চট্টগ্রাম বিভাগসহ দেশের সার্বিক নিরাপত্তা, আন্তঃ বা অন্তঃসাম্প্রদায়িক বিরোধ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি কিংবা মহামারী, স্থানীয় বাজার ব্যবস্থা, বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজার, বেসরকারি উন্নয়ন খাত, রাজনীতি ইত্যাদি সবকিছুই দাঁড়িপাল্লার একদিকে হেলে পড়ার আশঙ্কায় থেকে যাচ্ছে। উল্টোদিকে, মিয়ানমার এবং তাদের সহযোগীরা পপকর্ণ নিয়ে সিনেমা দেখার মত মজা করে বাংলাদেশের দৌড়ঝাঁপ উপভোগ করছে এবং সুযোগে “গুড জব বাংলাদেশ” বলে আমাদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। সু কি ছাড়া যেখানে মিয়ানমারের আর কারো নাম এদেশের মানুষ জানার প্রয়োজন মনে করেনি, সেখানে আজ সংবাদ-পাঠকেরা মিয়ানমারের নতুন নতুন মন্ত্রী-কর্মকর্তার নাম মুখস্ত করে যাচ্ছেন।

খুব স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, এমন বিপর্যয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে বাংলাদেশ কি করতে পারতো? আমার নিজের প্রশ্নে আমার নিজের সান্ত্বনা হলো, ২০১৭ তে এসে বাংলাদেশ আসলে মিয়ানমারের সাথে অনেকদিন ধরে চলে আসা কূটনৈতিক শীতলতার গর্তে পড়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে একদিনে আসেনি। বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকেই তারা পালিয়ে এই ভূখণ্ডে আসছে। আর বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে দলে দলে ১০-১০০ করে প্রতি বছরই তারা পালিয়ে এসেছে, স্থায়ী হয়ে অনেকে বিয়ে-থা করে এক্কেবারে খাঁটি বাংলাদেশী সেজেও গিয়েছে। এক্ষেত্রে, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতার কোন ইতিহাস আমি খুঁজে পেলাম না। আর যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশে অবাধ রোহিঙ্গা প্রবেশ, ইয়াবা পাচার এবং বিচ্ছিন্ন সামরিক উত্তপ্ততার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সামনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা দুর্বলতা অনেকটা ‘হা’ করেই ছিল। জিলাপিটা তখনই ধরিয়ে দিয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি, গলধঃকরণের বদলে সুদে-আসলে এই জিলাপি ফিরিয়ে দেওয়ার মত দক্ষতা বাংলাদেশ অর্জন করবে।