সামাজিক যোগাযোগ, বিকৃতি এবং আমার সমাজ (১ম পর্ব)

 

সাজ্জাদ মাহমুদ শুভ

ডায়লগ এসোসিয়েট, সংলাপ ও যোগাযোগ, সিপিডি

মূল কথাটা দিয়েই শুরু করছি – আমি, আমরা, আমাদের চারপাশ হঠাৎ করে খুব অস্থির-অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি। যেকোনো বিষয় খুব দ্রুত বুঝে ফেলছি, আগে-পিছে না দেখে, ইতিহাস-প্রেক্ষাপট না জেনেই দুম করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছি। পছন্দ না হলে যেকোনো যুক্তিই ফেলনা হয়ে যাচ্ছে। চকচকে সকাল দিয়ে শুরু করা দিনটা দুপুর হতে না হতেই কেমন ভ্যাঁপসা-গুমোট হয়ে উঠছে।

এমন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার মত যথেষ্ট পরিপক্কতা আমার অথবা আমার সমাজের আছে কিনা সে বিষয়ে ‘দুম করে সিদ্ধান্ত’ দেওয়ার আগে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো একটু বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। নতুন শতক শুরুর পর থেকে, গত ১৫/১৬ বছরে, প্রযুক্তি যেমন আমাদের কাছে তুলনামূলক সহজলভ্য হয়েছে তেমনি প্রযুক্তির উন্নয়নও হয়েছে ব্যাপকভাবে। ২০০৩-০৪ সালে ব্যঙ্গ করে বলা হতো, “একসময় রিক্সাওয়ালা-মাছওয়ালার হাতে মোবাইল ফোন থাকবে”, আর পরিবর্তিত বাস্তবতায় আজ গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও মোবাইল ফোন না-থাকাটা এক ‘অযোগ্যতা’, যা সমাজের অন্যান্য শ্রেণীতে হয়তো অক্ষমতা-ব্যর্থতা-বিচ্ছিন্নতা। এখন দেশে চার অপারেটরের প্রায় ১৫ কোটি মোবাইল ফোনের গ্রাহক রয়েছে (জানুয়ারি ২০১৮)। বিশ্বায়নের চাপে/প্রভাবে ‘হাতের মুঠোয় বিশ্ব’ যতদ্রুত আমার চারপাশে বাস্তবে রূপ নিয়েছে, সেই তালে বাড়েনি আমাদের জ্ঞ্যান, পরিপক্ক হয়নি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ। একটা প্রজন্ম যখন এখনও জানেই না ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ কি, আরেক প্রজন্ম তখন রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো হকারের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে ভার্চুয়াল-রিয়েলিটি বক্স। আর আমি বলি, এই দুই প্রজন্মের মাঝে ক্রমবর্ধমান ফাঁকা জায়গাটায় ভিড় করছে পচা-ভ্যাঁপসা অস্থিরতা, বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের ফাঁপা কলসির দাম্ভিকতা।

ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলাদেশে এগিয়ে থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। দেশের মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তাদের ৫০% ব্যান্ডউইথ খরচ করেন শুধু ফেসবুকের পেছনে। দেশে প্রায় আড়াই কোটির মত ফেসবুক ব্যবহারকারী থাকলেও এদের খুবই কমসংখ্যক সক্রিয়। কিন্তু, এই কম সংখ্যক ব্যবহারকারীর আচরণ ও কর্মকান্ড সমাজের মাঝে ফেলছে কল্পনীয়-অকল্পনীয় প্রভাব, নির্ধারণ করে দিচ্ছে দেশের আগামী প্রজন্মের মিডিয়া বেহ্যাভিয়ার। ব্যক্তি পর্যায়ে মানসিক-শারীরিক প্রভাবের পাশাপাশি সামষ্টিকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই মায়াবী জালের বহর দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কৃত্রিম এই প্ল্যাটফর্মের বাস্তবিক রূপ কত মধুর আর কত নৃশংস সেটা নিয়ে এই কিস্তিতে কিছু বলতে চাচ্ছি না। একক ব্যবহারকারী বা ব্যক্তি পর্যায়ে সৃজনশীলতার জানালা যতখানি না উন্মুক্ত হয়েছে তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি প্রসারিত হয়েছে বিকৃতির দরজা (দায়ভার যদিও মাধ্যমের নয়)। আর এই লক্ষ-কোটি ব্যক্তির মনোভঙ্গীর সামষ্টিক প্রভাব পড়ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। অনেক ক্ষেত্রে, গুচ্ছ গুচ্ছ সামাজিক মতবাদ গিয়ে রূপ নেয় বৃহৎ আঞ্চলিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিভেদে। আর এভাবেই ছাঁচবদ্ধভাবে মোথিত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের মূল্যবোধ ও জীবনদর্শন।

সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতাসাধন, ব্যবসায়িক উদ্যোগগ্রহণ, জাতীয়তাবোধের প্রচার, ধর্মীয় আচার পালন- কিছুই বাদ যাচ্ছেনা সামাজিক মাধ্যমে। এবং ব্যক্তিপর্যায়ে যে প্রভাবগুলো সবচাইতে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে, সেখানে বরাবরই এগিয়ে থাকছে তরুণ প্রজন্ম। এসবের মধ্য দিয়ে প্রকট আকারে ধরা পড়ছে আমাদের সমাজে বিরাজমান বিকৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে এই বিকৃতি ঘটছে নাকি বিকৃতি আগেই ছিল, বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার ফলে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে – এই বিতর্কে এখন যাচ্ছি না। কিন্তু, স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, এই বিকৃতিতে ধীরে ধীরে আমি-আমরা সকলেই আক্রান্ত হচ্ছি। এবং, আমি কোনোভাবেই নিশ্চিত নই যে আমার পরবর্তী প্রজন্ম এই বিকৃতি থেকে রেহাই পাবে, বরং আশংকিত- হয়তো  বিকৃতির কোনো এক পর্যায়ে কুপোকাত হবে।

বিকৃতির শিকার ব্যবহারকারী কিংবা বিকৃত ব্যবহারকারী, যেভাবেই বলি না কেনো, এদের বিশেষ কোনো শ্রেণীবিভাগ নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতা, শহর কিংবা গ্রামের জীবনাচরণ, পেশা, ভৌগলিক অবস্থান – এসব কোনো পর্যায় দিয়েই সাধারণ শ্রেনীবিন্যাস করা সম্ভব নয়। উচ্চশিক্ষিত-ধনী পরিবারের শহুরে ব্যবহারকারীর মাঝে যে বিকৃতি দেখা যাচ্ছে, অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবহনশ্রমিকের ভেতরেও একই বিকৃতি দেখা যাচ্ছে। নিজের মতামত, হোক সে যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক, জাহির করা এবং আশানুরূপ স্বীকৃতি পাওয়ার এক অবিরাম নেশা, সেটা আমার কাছে বিকৃতির প্রথম ধাপ বলে মনে হয়। এই ধাপে, কিশোর থেকে বুড়ো সকল বয়সের ব্যবহারকারীই দেখা যায়। এই ধাপ থেকেই একটি চরম ভ্রান্ত মতবাদ বা অসত্য কথাও প্রচারিত হওয়ার পর প্রাপ্ত লাইক-কমেন্ট এর ওপর ভর দিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে।  কিংবা বিকৃত ব্যবহারকারীর সামষ্টিক মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও প্রভাবিত হচ্ছে। সংখ্যায় নগণ্য কিন্তু প্রচারণায় অগ্রগণ্য বিকৃত ব্যবহারকারীরা এখন থেকেই পাল্টে দিচ্ছে আমার পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত।