বৈশাখের চুড়ি ও প্রবৃদ্ধির গুণগত মান

ড. আনিস পারভেজ

অতিরিক্ত পরিচালক, সংলাপ ও যোগাযোগ, সিপিডি

উন্নয়নের ধারণা বা বিতর্ক একটি ধাঁধায় রূপ নিয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বৈষম্য বেড়ে অধিকাংশ নাগরিকের আয় ও সম্পদ কমে গেলে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলো রঙিন চেহারা পাচ্ছে কোত্থেকে? পহেলা বৈশাখে গোটা দেশই হেসেছে, আসছে ঈদেও নিশ্চিত হাসবে—প্রায় সব পরিবারেই জামাকাপড় কেনাকাটা হবে। পরিসংখ্যান ভিত্তিক আলোচনা ও অনুসন্ধিৎসু সমালোচনার সাথে চোখের দেখায় কোথায় যেন একটা ফারাক আছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকের গড় আয় বেড়েছে অনেক, এখন যা মার্কিন ডলারে ১৬১০। বিবিএস-এর তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে দেখা গেছে গড় আয় বৃদ্ধির কারণে উল্লসিত হলেও মুহূর্তেই তা নিভে যায় যখন উপাত্ত বলছে আমাদের প্রকৃত আয় কমেছে ২.৬ শতাংশ হারে। কর্মে নিয়োজিত নাগরিকের মাথাপিছু মাসিক প্রকৃত আয় কমেছে ৩৪৪ টাকা। গ্রামে কমেছে শহরের চাইতে বেশি, পুরুষের তুলনায় নারীর আয় কমেছে বেশি। কর্মসংস্থান  কিছুটা বাড়ছে, কিন্তু তা মূলত সেবা ও অনুৎপাদন খাতে। অবিশ্বাস্যরকম ভাবে বেকারত্বের শিকার উচ্চশিক্ষিতেরা, যাদের প্রতি তিনজনে একজন বেকার।

বিবিএস পরিসংখ্যান দুটো চিত্র দেয়—ভাল এবং মন্দ, উৎসাহের এবং আশাহীনতার। কিন্তু একই সাথে ভাল ও মন্দ তো হতে পারে না। এ এক ম্যাজিকাল দ্বন্দ্ব। এ দ্বান্দ্বিকতার ভেতরটা বুঝতে হলে সংখ্যার পেছনে নাগরিকের জীবনাচার বুঝতে হবে।

দিন বদলেছে। বিশ্বায়ন ও মুক্ত অর্থনীতি তিন দশক ধরে দাবড়ে যাওয়ায় বাজারে এখন ভোগ্যপণ্যের পসার। মানুষ হয়েছে ভোগমুখী। সামর্থ্য না থাকলেও সামাজিক রীতি ও চাপে আজকের নাগরিক জামাকাপড় কেনে, কখনো বাইরে খায়, কিন্তু সম্পদ তৈরি করার জন্য সঞ্চয় থাকে না তাঁর হাতে। এ সমাজে একসময়, যখন দরিদ্র শোচনীয় দেশের অবস্থা, নাগরিকের সঞ্চয় প্রবৃত্তি ও সক্ষমতা ছিল। সে পারতো আয় থেকে অর্থ জমিয়ে সম্পদ গড়ে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। পুরনো একটি সমীক্ষায় বলে, ১৯৭০ সনে আদমজি পাটকলে শ্রমিকের মাসিক বেতন ছিল ৯৬ টাকা। পাঁচজনের একটি সংসারে শ্রমিক তার আয় থেকে মাসে ৬ টাকা জমাতে পারত।

এক কৃষকের অনেক সন্তান। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, অভাবের সংসারে সন্তান নিচ্ছেন কেন? কৃষকের সোজাসাপটা উত্তর, বেশি সন্তান অভাবের কারণ নয়, আসল কারণ হল টাকার আর বরকত নেই। প্রমিত ভাষায় বললে, এটাই সত্য যে আমাদের প্রকৃত আয় কমেছে এবং কমছে।

উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ নেই, যা আছে তা অ্তি কিঞ্চিৎ, ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সম্পদ বিকিয়ে উচ্চশিক্ষা সংসারে বৈরী ফল ছাড়া কিছুই আনছে না। অথচ শিক্ষাই হওয়ার কথা পুঁজি যা প্রকৃত উন্নয়নের মৌলিক যোগান। আজকের বাংলাদেশে শিক্ষা মানুষকে বিপন্ন করছে।

নাগরিক বিপন্নতর যখন ব্যাধি এসে আঘাত করে। চিকিৎসার ব্যয় পর্বতসম। রাষ্ট্র স্বাস্থ্যের দেখভাল করে না, করার পরিকল্পনাও নেই। পরিবারকে শেষ সম্বল বিক্রি করে হলেও চিকিৎসা চালিয়ে নিতে হয়।

প্রবৃদ্ধি ও মাথা পিছু আয়ের যে ইতিবাচক চিত্রটি আমরা পাচ্ছি বিভিন্ন রিপোর্ট, সংবাদ ও বিবৃতিতে, তা্র গুণগত অনুসন্ধান ও কাঠামোগত বিশ্লেষণে আমরা আসলে নাগরিকের বিপন্নতাকেই দেখতে পাই। আশঙ্কার বিষয়—এ বিপন্নতা কেবলই বাড়ছে, সমাজে আয় ভোগ ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।

পহেলা বৈশাখে যাকে দেখেছি মেলা থেকে লাল চুড়ি কিনছে, আসছে ঈদেও সে সম্ভবত রঙিন একটি শাড়ি পড়বে। আমাদের অনেকেই কেনাকাটা করছি ভোগবাদী সমাজের চাপে, সামর্থ্য আছে বলে নয়। তবে আমাদের ইচ্ছে আছে। নাগরিকের ইচ্ছে আছে স্বাচ্ছন্দ ও সৌখিনতার। এ ইচ্ছে মানবিক, যা পূরণ করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কেবল রাষ্ট্রই পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান বাড়িয়ে একটি উন্নত রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে।