Published in প্রথম আলো on Sunday, 26 February 2017
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বার্ষিক বক্তৃতা দিতে ঢাকায় এসেছিলেন জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির ভাইস চেয়ার সাকিকো ফুকুদা-পার। তিনি জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একাধিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের প্রধান লেখক। ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সিপিডি কার্যালয়ে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ
প্রথম আলো: উন্নয়নের গতিপ্রবাহ বিবেচনা করে বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ হয়তো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য প্রার্থী হওয়ার বিবেচনাধীন হবে। নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০২৪ সালের আগে এলডিসি থেকে বের হতে পারবে না বাংলাদেশ। আপনি কী মনে করেন?
সাকিকো ফুকুদা-পার: সত্তরের দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এলডিসি সৃষ্টি করেছে। তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশ্বব্যাপী সব দেশের জন্য সমান সুযোগ ছিল না। কিছু বড় দেশের জন্য বাণিজ্য-সুবিধা বেশি ছিল। আবার বেশ কিছু ছোট দেশের সক্ষমতাও কম ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোর নেতিবাচক প্রভাব থেকে এলডিসিগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এবং সক্ষমতাও বাড়ছে। এতে করে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে এলডিসি থেকে বের হলে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এটা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে; তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রথম আলো: তবে কি এলডিসি থেকে বের হওয়া উচিত হবে না?
সাকিকো ফুকুদা-পার: আমি সেটা বলছি না। রূপক অর্থে বলা যেতে পারে—বাংলাদেশসহ এলডিসিগুলো ‘ক্র্যাচে’ ভর করে হাঁটছে। এলডিসি থেকে বের হওয়া মানে নিজের পায়ে হাঁটতে হবে। এ জন্য পায়ের পেশি শক্ত করতে হবে।
প্রথম আলো: এখন শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সংখ্যাকে উন্নয়ন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। মানুষের জীবনে প্রবৃদ্ধির সুফল কতটা গেল—সেটাই বিবেচনার বিষয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
সাকিকো ফুকুদা-পার: একটি সমন্বিত পরিকল্পনা হিসেবে এসডিজি খুবই ভালো পরিকল্পনা। এখানে টেকসই উন্নয়নের জন্য সবকিছু বলা আছে। টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার—সবই আছে এসডিজিতে। আগামী কয়েক বছরে এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নয়নকে টেকসই করতে বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন—এসব খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। কয়েক দশক আগে কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর কী ছিল—এটা সবাই জানে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করে তারা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দশক আগে ইউএস এইড তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, কোরিয়ার মানুষ খুবই অলস। এখন কিন্তু তারা খুবই পরিশ্রমী জাতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে জাপান অবকাঠামো খাতেও বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এই দুটি দেশ মাত্র এক প্রজন্মেই দেশকে বদলে দিয়েছে।
প্রথম আলো: সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। এসডিজি অর্জনে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোন খাতকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত?
সাকিকো ফুকুদা-পার: এমডিজি অর্জনের বাংলাদেশ বেশ ভালো করেছে। আমি মনে করি, এসডিজি অর্জনে কী করতে হবে—এর উত্তর দেওয়া সহজ না। তবে এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশকে দ্বিগুণ পারদর্শিতা দেখাতে হবে। বাংলাদেশে লিঙ্গবৈষম্য আছে। এ বিষয়টি সব সময়েই উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া পুষ্টি গ্রহণের দিক থেকেও বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তায় বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন বেশ ভালো। তবে সরবরাহ ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোতে সমস্যা আছে। এগুলো ঠিক করতে পুরো কৃষি খাতেই বিনিয়োগ করতে হবে।
সব মিলিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ লাগবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসা উচিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিবেশসম্মত ভোগ ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারে বেসরকারি খাত। আবার শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারে বেসরকারি খাত।
প্রথম আলো: দারিদ্র্য দূর করতে বাংলাদেশ বেশ সফল। এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্য রয়েছে। আপনি কি মনে করেন, দারিদ্র্য বিমোচনে সঠিক পথে আছে বাংলাদেশ?
সাকিকো ফুকুদা-পার: দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ অনেক সংগ্রাম করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্যে আমি খুবই সন্তুষ্ট। বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। বিদ্যমান আয়বৈষম্য দূর করতে হবে। মানসম্পন্ন কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বহু লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকার ঝুঁকি রয়েছে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের ইস্যুর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টি সম্পৃক্ত করতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি এখন ৭ শতাংশের বেশি। এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
সাকিকো ফুকুদা-পার: বাংলাদেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গর্ব করা যায়। কিন্তু সন্তুষ্ট হয়ে গেলে চলবে না। এখন সরকারকে ভাবতে হবে, এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুবিধা সব মানুষ পাচ্ছে কি না। প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে গেলে, তা নিয়ে আরও বেশি গর্ব করা উচিত।